সমুদ্র যতই বিস্তৃত হোক, আলাদা করতে পারে না শিকড় থেকে, বার্লিনে ৪৮ বছরের দুর্গোৎসব ফিরছে ঐতিহ্যের নতুন রূপে, নতুন নামে

শাল্মলী কুণ্ডু: এই শরতে বার্লিন আবার সাক্ষী হতে চলেছে এক চির চেনা অথচ নবউদ্দীপ্ত আগমনী মুহূর্তের। শহরের প্রাচীনতম দুর্গাপূজা আয়োজক দল, নতুন নামে—নমস্তে বার্লিন ই.ভি.—ফিরে আনছে দুর্গোৎসবের সেই অনন্য আবহ। ১৯৭৫ সালে হাতে গোনা কিছু বাঙালি তাঁদের মাতৃভূমির গন্ধ আর আবেগকে বাঁচিয়ে রাখতে যে পূজা শুরু করেছিলেন, সেটি আজ পেরিয়ে এসেছে ৪৮ বছরের দীর্ঘযাত্রা।
এ বছরের পূজার তাৎপর্য বিশেষ। কোভিড মহামারির বাধা কাটিয়ে এবার আবার একত্রিত হচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। প্রথম প্রজন্মের অনেকে আর বেঁচে নেই, তবে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকেই উৎসাহ আর প্রেরণা খুঁজে নেয় বর্তমান প্রজন্ম। নমস্তে বার্লিন–এর সম্পাদক অসিত দত্ত জানালেন “এ বছরের পূজা উৎসর্গ করাহয়েছে তাঁদের প্রতি, যাঁরা একদিন শুরু করেছিলেন, আর সেই তৃতীয় প্রজন্মকে, যারা আগামী দিনে এই পূজাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ।" দ্বিতীয় প্রজন্ম, যারা ২০১০ সালে দায়িত্ব নিয়েছিল, আজ দাঁড়িয়ে আছে উত্তরাধিকার ও ধারাবাহিকতার সেতুবন্ধন হয়ে।
কলকাতা থেকে আসছেন পুরোহিত সুমিত মুখার্জি। তাঁর সূক্ষ্ম যত্নে সন্ধিপূজা, হোম থেকে শুরু করে দেবীর বিসর্জন—সব আচারই সম্পন্ন হবে নির্দিষ্ট সময়ে, একেবারে বাংলার মতো করে। যখন অনেক উৎসবই বাণিজ্যিকতার ভিড়ে নিজস্বতা হারাচ্ছে, তখন নমস্তে বার্লিন ই.ভি. বেছে নিয়েছে ঘরোয়া ও আন্তরিক রূপকে। গৌরী বোস, যিনি ১৯৭৫ সালে পুজোর সূচনা থেকে এর সঙ্গে যুক্ত অন্যতম প্রবীণ সদস্য, আয়োজন প্রসঙ্গে বলছেন, “আমাদের দুর্গা পূজা সম্প্রদায় অনেকটা যৌথ পরিবারের মতো।” সঙ্গেই তিনি বলেন, “আমরা ভালোবাসি, কখনও কখনও দ্বন্দ্বও হয়, তবে সবসময় একত্রহয়ে মা দুর্গাকে সর্বোচ্চভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গেআরাধনা করি।”
তবে এই পূজা শুধু ধর্মীয়আচার নয়, এটি যেনএক পরম মিলনমেলা। পূজামণ্ডপেপ্রতিধ্বনিত হবে ঢাকের তালে মাতৃবন্দনা, ধূপ-ধুনোর গন্ধে ভরে উঠবে বাতাস।থাকবে অঞ্জলি, আর থাকবে বর্ণাঢ্যসাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—সঙ্গীত, নৃত্য ও নাটকের মেলবন্ধন, যা যেন সরাসরি নিয়ে যাবে কলকাতার দুর্গোৎসবের প্রাণকেন্দ্রে।
তবু এই পূজার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল, প্রজন্মান্তরের ধারাবাহিকতা। গঙ্গার তীর থেকে বহু দূরে, বিদেশের মাটিতে থেকেও দুর্গাপূজা কেবল টিকে থাকেনি, বরং বেড়েছে, বেঁধেছে স্মৃতি, মূল্যবোধ ও পরিচয়ের বন্ধন। বার্লিনে তিন প্রজন্মের সম্মিলিত এই প্রয়াস প্রমাণ করছে—ঐতিহ্যের শক্তি ভূগোল ও সময়কে অতিক্রম করতে পারে।
আসলে, ২০২৫-এর এই পূজা শুধু এক উৎসব নয়—এ এক শ্রদ্ধার্ঘ্য। যাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন বার্লিনে দুর্গাপূজা করার, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা, যাঁরা সেই স্বপ্নকে যুগে যুগে লালন করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, আর যাঁরা আগামী দিনে এই পূজা বহন করবেন, তাঁদের জন্য এক প্রতিশ্রুতি। নমস্তে বার্লিন ই.ভি. –র ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে মায়ের আগমন এ বছর শুধুই দেবীর প্রত্যাবর্তন নয়, বরং এই দৃঢ় বিশ্বাসের ঘোষণা—সমুদ্র যতই বিস্তৃত হোক, শিকড় থেকে মানুষকে আলাদা করা যায় না।