কুমোরটুলি থেকে যায় প্রতিমা, প্রবাসী বাঙালিদের কাছে আবেগ হয়ে উঠেছে ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট্রাল ভ্যালির এই দুর্গাপুজো

বাঙালির দুর্গোৎসব- দূর প্রবাসে থেকেও এই আবেগ কখনও মলিন হয় না, বরং আরও মধুর হয়ে ওঠে, কারণ সেখানে মিলেমিশে থাকে আমাদের প্রবাসী মনের ভেতরে জড়িয়ে থাকা অজস্র স্মৃতির টান।

Usa california durga puja all you need to know

মণিদীপা দাশ ভট্টাচার্য-স‍্যান ফ্র‍্যানসিসকো, ক‍্যালিফোর্নিয়া

প্রবাসের আকাশে যখন শরতের মেঘেরা নরম তুলোর মতো ভেসে যায়, তখন বাঙালির হৃদয়ের অন্তঃস্থল জেগে ওঠে এক অনন্য সুর। যে অনুভূতির উষ্ণ আবেশ, পৃথিবীর প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে গভীর থেকে উঠে আসে। বাঙালির দুর্গোৎসব- দূর প্রবাসে থেকেও এই আবেগ কখনও মলিন হয় না, বরং আরও মধুর হয়ে ওঠে, কারণ সেখানে মিলেমিশে থাকে আমাদের প্রবাসী মনের ভেতরে জড়িয়ে থাকা অজস্র স্মৃতির টান।

 শরতের নীল আকাশে, মেঘের আড়ালে সূর্যের আলোর লুকোচুরি, আর ভোরের বাতাসে ভেসে আসা শীতল ঠান্ডা—সব যেন মনে করিয়ে দেয়, মহামায়া আগমনীর বার্তা । সাত সমুদ্র দুরে এই ক্যালিফোর্নিয়াতেও যখন শরতের নরম রোদ গায়ে এসে লাগে, তখন সেই আমাদের প্রবাসী বাঙালি মনগুলোও আনন্দের আবহে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। আমার কাছে এই সময়, ক‍্যালিফোর্নিয়ার ‘পূর্বা’র আয়োজিত দুর্গাপুজো ঠিক এমনই গভীর এক আবেগের জায়গা।

 ক‍্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট্রাল ভ‍্যালির অন‍্যতম বাঙালি ক্লাব হল ‘পূর্বা’। এই বছর পূর্বার দুর্গোৎসব চতুর্থ বছরে পা দিল। এই পুজো এখানকার বাঙালিদের কাছে শুধুমাত্র পুজো বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। বরং সমস্ত বেড়া পেরিয়ে, এই পুজো আজ এখানকার সব ভারতীয়দের কাছে এক মহোৎসবের মিলনমেলার রূপ নিয়েছে। এই বছরের ‘পূর্বা’র পুজোর বিশেষ আকর্ষণ আমাদের কাছে আরও একরাশ আনন্দ বয়ে এনেছে। কলকাতার কুমোরটুলি থেকে আগত নতুন প্রতিমা, আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে দেশীয় শিল্পের গন্ধ। মাটির প্রতিমার গায়ে যেন ছুঁয়ে আছে পবিত্র মা গঙ্গার ঢেউয়ের স্পর্শ। প্রতিমার মুখাবয়বে ফুটে ওঠা মায়ের মাধুর্য যেন মুহূর্তে সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় আমাদের প্রত‍্যকের শৈশবের দিনগুলোতে।  

 ‘পূর্বা’র এবারের পুজোর আরও একটি অন‍্যতম আকর্ষণ আলোকসজ্জা। যা তৈরি হচ্ছে পূর্বার সদস্যদের নিজস্ব হাতের ছোঁয়ায়। বিদ্যুতের ঝলকানিতে নয়, ভালোবাসার স্পর্শে ঝলমল করছে এই আলোকসজ্জা। প্রতিটি আলোয়, প্রতিটি তারে যেন বাঁধা আছে তাদের পরিশ্রম, ভালোবাসা, নিষ্ঠা ও উৎসাহ। প্রবাসের ব‍্যাস্ত জীবনের পরেও, পূর্বার সদস‍্যদের বিগত বেশ কয়েক মাস ধরে, নিয়মিত মিটিং, আলোচনা-পর্যালোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে পরিপূর্ণ সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করে চলে। প্রবাসে থেকেও তারা প্রমাণ করে দিচ্ছেন, দুর্গাপুজো মানে আসলে, একসঙ্গে হাতে হাত রেখে, মিলেমিশে কাজ করার আনন্দে মেতে ওঠা।

 আমাদের কাছে ‘পূর্বা’র এই দুর্গাপূজো, তাই শুধু মায়ের আগমনের প্রতীক নয়, বরং এখানকার প্রতিটি প্রবাসী বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক নতুন আখ‍্যান। এই উ‍ৎসবে মিশে আছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা, ভক্তি ও বন্ধুত্ব, উৎসব ও আলোর রোশনাই।‘পূর্বা’র কোষাধ্যক্ষ শ্রী গৌরব বসু, ও সম্পাদক দীপক মন্ডল এবং প্রেসিডেন্ট প্রিয়াঞ্জলী আইচ যারা এই পুজোর আয়োজনে বটবৃক্ষের মতো এক একটি স্তম্ভ। তাদের সঙ্গে এই পুজো নিয়ে আলোচনায় এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা তৈরি হল।

 তাদের মতে, ‘এই দুর্গাপূজো ঘিরে যে উৎসবের উন্মাদনা যে আবেগ তা যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যারা, এই বিদেশের মাটিতে জন্মেছে, বড় হচ্ছে তাদের মধ্যেও আমাদের বাঙালি ঐতিহ্য, সংস্কৃতির রূপ, রস সব‍কিছু সমান ভাবে মিশে থাকে। আমরা আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির থেকে এত দূরে চলে এসেছি, কিন্তু আমাদের মনের গভীরে রয়ে গেছে, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ’।

 আর সেখানেই পূর্ণতা পায় পূর্বার আয়োজন। ছোটদের গান, কিশোরীদের নাচ, প্রবাসী প্রতিভাদের সমন্বিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—সব মিলে পূর্বার সাংস্কৃতিক মঞ্চ যেন হয়ে ওঠে ঝলমলে এক রঙিন ক্যানভাস। দেশ থেকে আগত বহু গুণী শিল্পীরাও অংশ নেন এই উৎসবে, তাদের সুরেলা কণ্ঠে দর্শকাসনে বসে থাকা প্রতিটি মানুষ যেন ফিরে যান, ফেলে আসা সেই চেনা বাংলা পুজোর স্মৃতিতে। 

 বাঙালির কাছে পুজোর সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা পড়ে বাঙালির পেটপুজো। খাদ্য রসিক হিসেবে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। আমাদের প্রবাসের এই পুজোতেও কিন্তু সেই পেটপুজোর কোন খামতি নেই। আমাদের মহিলা সদস‍্যদের হাতে বানানো ভোগের খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পাপড় যেমন মহামায়ার পরমান্নের আয়োজন হয়, তেমনই পুজোর এই তিনদিনে, পুজো প্রাঙ্গনের আশেপাশে থাকে রকমারি ফুড স্টল। ফুচকা থেকে কাবাব, মিষ্টি থেকে বিরিয়ানি—প্রবাসী বাঙালির রসনাতেও তাই বাজে উৎসবের ঢাক।

 ক‍্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন হাউসের আকাশ যখন মিলেমিশে যায়, মহামায়ার পুজোর ধুনোর গন্ধে, ঢাকের আওয়াজে, গান, হাসি আর গল্পে, তখন মনে হয়, প্রবাস আর দেশ আলাদা কোথায়? পূর্বার দুর্গাপূজো যেন এক অদৃশ‍্য সেতুবন্ধন, যা আমাদের প্রত‍্যেকটি ভারতীয়কে একসূত্রে গেঁথে রাখে সবাইকে। আমাদের এই পুজো শুধু প্রতিমার আরাধনা নয়, এটি বাঙালির ঐক্যের প্রতিমূর্তি। প্রবাসের আলোয় জ্বলে ওঠা পূর্বার দুর্গাপূজো প্রমাণ করে দেয়—ভাষা, সংস্কৃতি আর উৎসবের টান অক্ষরেখার দূরত্বের ব‍্যবধান এক নিমেষে মুছে দিতে পারে।