ভিড় ঠেলে উত্তম কুমারের ছবির টিকিট কাটা থেকে মণ্ডপে নিজের জন্য ভিড়, দুইই দেখিয়েছে দুর্গাপুজো: চিরঞ্জিৎ

Chiranjeet Chakraborty: শুরু হয়ে গিয়েছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। এহেন উৎসবের আমেজে বুঁদ হয়ে অতীতের পাতা উল্টোলেন অভিনেতা-রাজনীতিবিদ চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী। বর্ষীয়ান শিল্পীর যেমন শোনালেন দারুণ সব রংদার পুজোর অভিজ্ঞতা তেমনই জানালেন দুর্গাপুজো এখন যেমন ভাললাগার তেমন ব্যস্ততারও।

Chiranjeet Chakraborty opens up about his Kolkata Durga Puja experience

শুরু হয়ে গিয়েছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। এহেন উৎসবের আমেজে বুঁদ হয়ে অতীতের পাতা উল্টোলেন অভিনেতা-রাজনীতিবিদ চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী। বর্ষীয়ান শিল্পীর যেমন শোনালেন দারুণ সব রংদার পুজোর অভিজ্ঞতা তেমনই জানালেন দুর্গাপুজো এখন যেমন ভাললাগার তেমন ব্যস্ততারও। আবার নিজের ক্যানভাসে মনের ইচ্ছেগুলোকে রং-তুলি দিয়ে একমনে প্রকাশ করারও। এবং এই শারদ আবহে অবশ্যই বাছাই করে গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়া। 

“ছোটবেলায় কেটেছে ঢাকুরিয়ায়। মায়ের হাত ধরে ধরে মণ্ডপ ঘুরতাম, দেবী দুর্গাকে চিনিয়েছিলেন মা-ই। সেই সময়ে এখনকার মতো বছরভর এত পুজো একেবারেই হত না। অল্প বড় হওয়ার পর, বাবা গোলপার্কে বাড়ি বানালেন, সেখানে চলে এলাম। পুজো দেখার জন্য তখন সারা কলকাতা ঘুরে বেড়িয়েছি। অন্তত ১০০টা মণ্ডপ দেখতামই। কারণ বন্ধুদের মধ্যে কে বেশি পুজোর মণ্ডপ দেখল, এরকম একটা ছেলেমানুষি প্রতিযোগিতা ছিল। রোজ এর ওর থেকে খবর নিতাম, কে ক'টা দেখল। কোনও বছর আমি জিতেছি, কোনও বছর হেরেছি। কিন্তু এই বিষয়টা সেই সময়ে আমাদের মধ্যে খুবই একটা বড় ব্যাপার ছিল। এরপর, আমার কলেজজীবন পর্যন্ত দুর্গাপুজো নিয়ে একটা অন্যরকম উত্তেজনা বোধ করতাম, কারণ পুজোর সময় বড়পর্দায় ভাল, ভাল সব ছবি মুক্তি পেত। সেগুলো দেখার পরিকল্পনা করতাম, বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে হুড়োহুড়ি করে লাইন দিয়ে সিনেমার টিকিট কেটে ছবি দেখতাম। মনে আছে, একবার পুজোতে উত্তমকুমারের ছবি রাজদ্রোহী মুক্তি পেয়েছিল। সেই ছবি দেখার জন্য মুক্তি পাওয়ার চারদিন আগে পদ্মশ্রী সিনেমা হলে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে বহু কষ্ট  টিকিট কেটেছিলাম! 


এরপর সংবাদ পাঠক হিসেবে কেরিয়ার শুরু হল, তার কিছু পরেই ছবিতে অভিনয়। ব্যাস! তারপর থেকেই আর পুজোয় মণ্ডপ ঘোড়া একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেল। কারণ জনপ্রিয়তা পেয়ে গিয়েছিলাম কেরিয়ারের প্রথম থেকেই। তাই পুজোর সময় রাস্তাঘাটে তো বটেই, মণ্ডপের ভিতরেও লোকজন ঘিরে ধরত। তখন তো নিজস্বীর কোনও ব্যাপার ছিল না, অটোগ্রাফের খুব চল ছিল। খুশি মনেই মেটাতাম অনুরাগীদের আবদার। তবে প্রথমবার পুজোয় ‘মবড’ হওয়ার স্মৃতি কিন্তু আজও আমার কাছে অমলিন। এরপর পুরোপুরি অভিনেতা হিসেবে কেরিয়ার শুরু করার পর পুজোয় খেয়ালখুশি মত ঘোরা পুরো বন্ধই হয়ে গেল। বদলে যেটা হত -তা হল বিভিন্ন শারদ সম্মানের বিচারকের দায়িত্ব পাওয়া। তার ফলে বহু ছোট-বড় নানান চমৎকার পুজো মণ্ডপ দেখার সুযোগ হত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কোনও ভিড়, ঠেলাঠেলির মধ্যে না গিয়েই।  

এখন প্রতি পুজোতে আর কলকাতায় থাকা হয় না। তবে পুজোতে শহরে থাকলে আমার বিধানসভা অঞ্চল বারাসাতে যাবই। আবার কোনও পুজোতে ইংল্যান্ডে থাকি, কখনও বা আমেরিকায়। আমেরিকাতে কিন্তু খুব বেশি পুজো পুজো অনুভব করিনি। তবে ওখানে হয় আয়োজন। আমার মেয়ে সপরিবারে আমেরিকায় থাকে। তখন আমার নাতনি বেশ ছোট। একবার পুজোতে ওঁর নাচের অনুষ্ঠান ছিল, দেখতে গিয়েছিলাম। সেবারের পুজোর স্মৃতি আমার কাছে তাই বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। তবে ইংল্যান্ডে দুর্গাপুজো কিন্তু অনেক বেশি জমজমাট। হৈ হৈ করে সেখানকার বাঙালিরা পুজো করেন। বেশ অনেকগুলো পুজো হয় ওখানে, বেশ জমাটি ব্যাপার-স্যাপার। আর ওখানে কিন্তু দেখেছি, আমার কাজের বহু অনুরাগীরা রয়েছেন। একবার আলাপ হয়েছিল ওখানকার এক বাঙালি ডাক্তারের সঙ্গে। তিনি আমাদের এখানে আর জি কর হাসপাতালে একসময় ডাক্তারি করতেন, বর্তমানে ইংল্যান্ডের নামী অর্থোপেডিক। তো দেখি, তিনি ইংল্যান্ডের বহু পুজোর পৌরোহিত্য করেন! সোজা কথায়, পুজোর সময় পুরুতমশাইয়ের দায়িত্ব পালন করেন! তাঁর সঙ্গে পুজো দেখা, ঘোরাটা বেশ ইন্টারেষ্টিং হয়েছিল সেবার। ভারী মজার। 


এখন পুজো অনেক বেশি কর্পোরেট, অনেক বেশি ডিজাইনড। তেমন মজা পাই না আর। আজকাল তাই পুজো মানে আমার কাছে অবসর, ক'টা দিন সব ধরনের কাজ থেকে একটু ছুটি, নিজের মত সময়, অবসর কাটানোর সুযোগ। কখনও সস্ত্রীক ভিন রাজ্যে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। সেটা পাহাড়ের কোলে ছোট্ট কোনও নিরিবিলি জায়গা হতে পারে অথবা দক্ষিণ ভারত। হট্টগোলের থেকে পুরোপুরি বাইরে থাকি। আমার কাছে পুজো এখন অনেক শান্ত। এবং সেই সময়টায় মন দিয়ে আঁকি। ও হ্যাঁ, কলকাতায় থাকলে পুজোর সময় বাড়িতে কিন্তু জমিয়ে আড্ডাও দিই বন্ধুদের সঙ্গে। কখনও ছোটবেলার বন্ধুরা আসে কখনও বা ইন্ডাস্ট্রির। আর আমেরিকায় যদি পুজোতে থাকি, তাহলে তো আঁকবই...আসলে, এখন আমি একটু নিজের জন্য সময় পেলেই ক্যানভাসের সামনে রং-তুলি নিয়ে বসে যাই। 

পুজোর স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে একটা ঘটনা  মনে পড়ল। এই ফাঁকে বলে ফেলি। শুনলে হয়ত মজা পাবেন। মিঠুন মানে মিঠুন চক্রবর্তী কিন্তু আমার বহু বছরের বন্ধু। বোম্বেতে নায়ক হিসেবে তখন ও মোটামুটি দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আমিও বাংলা ছবিতে কাজ করছি। সেরকম এক সময়ের পুজোতে মিঠুন আর আমি গভীর রাতে নিজেদের গাড়ি চেপে ঠাকুর দেখতে বেড়িয়েছি। গভীর রাত, লোকজন কম রাস্তায়। যাঁরা দেখছেন আমাদের, চোখ-টোখ কচলে ঠিকঠাক চেনার আগেই আমরা সরে পড়ছি। সল্টলেকের দিকে একজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছিল – “আরে, আরে মিঠুন-চিরঞ্জিৎ না?' সেই চিৎকার শুনে বাকিরা এদিক-ওদিকে তাকানো শুরু করতেই পায়ের স্পিড বাড়িয়েছিলাম গাড়ির দিকে। এরপর মিঠুন আমাকে নিয়ে গেল ওর পাড়া, উত্তর কলকাতার জোড়াবাগানে। ওর ছোটবেলার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলাপ করাল। দেখাল কোথায় আড্ডা দিত। পাড়ার মণ্ডপে ঢুকে মিঠুনের তারপর সে কী নাচ! ব্রেক ডান্সের কত মুভস দিচ্ছিল...খুব মজা হয়েছিল। তারপর সে রাতেই গাড়ি করে মিঠুনকে দমদম বিমানবন্দরে নামিয়ে দিলাম। 

আজও মিঠুন যদি পুজোয় রাতে গাড়ি করে চুপিচুপি কলকাতা ঘোরার পরিকল্পনা এঁটে আমাকে ডাকে, আমি কিন্তু চলে যাব!”