হাজার ঝক্কি সামলেও উইকএন্ডের দুর্গাপুজো মনে করাচ্ছে দেশের মাটিকে, উৎসবের মেলবন্ধনে সাজছে মেলবোর্ন
Durga Puja 2025: প্রবাসী বাঙালিদের কাছে দুর্গাপুজো অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। সারা সপ্তাহের কাজের ঝক্কি সামলে শনিবার-রবিবার পুজো করতে হয়। বেশির ভাগ সময়ই তিথি অনুযায়ী করা যায় না।

সুদেষ্ণা পাল ভট্টাচার্য্য
আমি অস্ট্রেলিয়ায় আছি প্রায় দশ বছর। কিন্তু এর মধ্যে প্রথম বেশ কিছু বছর কেটেছে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার পার্থে। তারপর কর্তার ট্রান্সফারের সূত্রে দু’বছর আগে মেলবোর্নে আসা। পার্থে থাকাকালীন দুর্গাপুজো কাটানোর অভিজ্ঞতা থাকলেও সেটা ছিল একেবারেই আলাদা। একে তুলনায় ছোট শহর, তার ওপর বড় পুজো বলতে ছিল ওখানকার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের পুজো। সেখানকার পুজোর আবেগ আর আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে যেত। তবে দু’বছর আগে মেলবোর্নে এসে চমকে গিয়েছিলাম। এখানে বাঙালির সংখ্যা তুলনামূলক অনেক বেশি। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রতি বছর এখানে প্রায় ১০ থেকে ১২টা পুজো হয়। শহরটা বড়, তাই শহরের বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনগুলো নিজেদের মতো করে পুজো করে।
এই পুজোগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ ভিক্টোরিয়ার (BAV) পুজো। এই পুজোর সূচনা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। মনে করা হয় এটাই অস্ট্রেলিয়ার প্রথম দুর্গাপুজো যেখানে কলকাতা থেকে ঠাকুর আনা হয়েছিল। প্রতি বছর এখানে পুজোর পাশাপাশি থাকে জমিয়ে পেটপুজোর আয়োজন, জামা-কাপড় ও খাবারের স্টল, এবং নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই বছর আবার ভিক্টোরিয়ার পুজোয় বিশেষ আকর্ষণ থাকছে ঢাকের তালে ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা। এক কথায়, কলকাতার পুজোর মেজাজ বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ ভিক্টোরিয়ায় অনেকটাই পাওয়া যায়।
তবে এবার প্রথমবার পুজোর আয়োজন করেই নজর কেড়েছে বঙ্গসাথীর পুজো। প্রথম বছর হলেও ঠাকুরের নান্দনিক মুখ, চালচিত্রের বাহার, পুজোর ব্যবস্থাপনা বেশ প্রশংসনীয়। পুজো চলাকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চিনের শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। দেবী দুর্গা মূর্তির ছবি তোলার উৎসাহ প্রবল। বাকি পুজোগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রী-শক্তি, Wyndham দুর্গোৎসব, উমার পুজো।
কিন্তু মেলবোর্নে এসে যে পুজো আমাকে সবচেয়ে বেশি আপন করে নিয়েছে, তা হল সৌমেনদা ও প্রীতমদার পুজো। এর কোনও পোশাকি নাম নেই, বিজ্ঞাপন নেই, নেই স্পনসরশিপের ঝলকানি, নেই বাহারি খাবার বা জামা-কাপড়ের স্টল। আছে শুধু আন্তরিকতা, বাড়ির পুজোর নস্টালজিয়া এবং সবার সঙ্গে মিলেমিশে উৎসব উদযাপনের আনন্দ। কথায় কথায় সৌমেনদার থেকে জানতে পারি, ছেলেবেলায় মামারবাড়ির দুর্গাপুজোর স্মৃতিকে আবার ফিরিয়ে আনতেই আজ থেকে মাত্র দু’বছর আগে সৌমেনদা আর তার স্ত্রী মৌসুমীদি প্রথম এই পুজো শুরু করেন নিজেদের বাড়ির বাগানে | তারপর এগিয়ে আসেন বন্ধু প্রীতমদা, ছোট্ট বাগানের গন্ডি পেরিয়ে সেই পুজোর উৎসাহ ছড়িয়ে পরে আশেপাশের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যেও| এখন দু-তিন মাস আগে থেকেই শুরু হয় সাংস্কৃতিক উৎসবের মহড়া। ঠিক আমাদের ছোটবেলার পাড়ার জলসার মতো। সবাই মিলে স্টেজ সাজানো, লাইটের ব্যবস্থা করা, পুজোর আয়োজন, রান্নার জোগাড়। হাজার ঝক্কির মাঝেও থাকে অফুরন্ত আনন্দের ছোঁয়া।
এই বছর সৌমেনদাদের পুজো হচ্ছে অক্টোবরের ৪ এবং ৫ তারিখ। তিথি অনুযায়ী যদিও ততদিনে দশমী হয়ে যাবে, তবুও মন পড়ে রয়েছে সেই দু’দিনের অপেক্ষায়। মনে হচ্ছে, সেদিনই নতুন করে শুরু হবে আনন্দ, মিলন আর উৎসবের রঙিন গল্প। আমাদের মতো প্রবাসী বাঙালিদের কাছে দুর্গাপুজো অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। সারা সপ্তাহের কাজের ঝক্কি সামলে শনিবার-রবিবার পুজো করতে হয়। বেশির ভাগ সময়ই তিথি অনুযায়ী করা যায় না। কিন্তু আমরা যারা বাইরে থাকি, যারা নিজের দেশের মাটি, সংস্কৃতি, কাছের মানুষগুলোকে প্রতি মুহূর্তে মিস করি, তাদের কাছে কয়েকদিনের জন্য হলেও এই পুজো আমাদের দেশকে মনে করিয়ে দেয়। প্রবাসে দুর্গাপুজো আমাদের কাছে শুধু উৎসব নয় এটা একটি হৃদয়ের মিলন, স্মৃতির পুনর্জন্ম।