ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন? সেই ছবিই ফুটে উঠেছে কেমব্রিজের আই.সি.এস. দুর্গোৎসবে

প্রবাসের বুকে দুর্গাপূজো মানে শুধু আনন্দ আর ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়। বাঙালিদের কাছে এটাই হয়ে ওঠে পরিচয়ের উৎসব, শিকড়ের সঙ্গে নতুন করে মিশে যাওয়ার মুহূর্ত।

Current situation of Europe is the theme of Cambridge ICS Durga Puja this year

আজকাল ওয়েবডেস্ক: প্রবাসের বুকে দুর্গাপূজো মানে শুধু আনন্দ আর ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়। বাঙালিদের কাছে এটাই হয়ে ওঠে পরিচয়ের উৎসব, শিকড়ের সঙ্গে নতুন করে মিশে যাওয়ার মুহূর্ত। সেই আবেগ নিয়েই কেমব্রিজের আই.সি.এস. কমিটি প্রতিবছর আয়োজন করে বর্ণাঢ্য দুর্গাপুজো। এই বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ২০২৫ সালে বিদেশের মাটিতে এসে উমা মায়ের আগমনকে ঘিরে আবারও এক হল মিলন, আনন্দ আর মানবতার মঞ্চ।

চকচকে প্রতিমা, ঢাকের গর্জন, আলোকসজ্জার ঝলক আর সুগন্ধি ভোগ-প্রসাদের সুবাস সব মিলিয়ে নেদার হল যেন রূপ নিয়েছিল এক টুকরো কলকাতার। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি পুজো, অঞ্জলি, ভোগ আর গান-নৃত্যে মুখর ছিল পরিবেশ। শুধু বাঙালি নন, আশপাশের বিভিন্ন দেশের প্রতিবেশী, সহকর্মী ও বন্ধুরাও এসে শরিক হলেন এই উৎসবে। প্রবাস জীবনের ব্যস্ততা, নিঃসঙ্গতা আর ভিন্ন সংস্কৃতির ভেতর এই আয়োজন মনে করিয়ে দিল আমাদের শেকড় এখনও গভীরে অটুট।

তবে এবারের পুজোর ভাবনা ছিল একটু অন্যরকম। তুলে ধরা হয়েছিল ইউরোপ মহাদেশের বিশেষ পরিস্থিতিকে। বর্তমানে ইউরোপ জুড়ে ‘উদ্বাস্তু সমস্যা’ আলোচ্য বিষয়। বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ যুদ্ধ, সন্ত্রাস, দারিদ্র্য কিংবা জলবায়ু বিপর্যয়ে ঘরছাড়া। আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরিত্রিয়া, সুদান কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশ থেকে হাজারও মানুষ যুক্তরাজ্যে সামান্য আশ্রয়ের খোঁজে এসেছেন। কেমব্রিজ শহরেও এসে উঠেছেন অনেকে। অচেনা দেশে নিরাপত্তা এবং নতুন জীবন গড়ে তোলার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন।

এই বাস্তবতাকে কেন্দ্র করেই পূজা প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় বিশেষ আলোচনা সভার। বক্তারা মনে করিয়ে দেন ‘মা দুর্গা যেমন অসুরকে দমন করে শান্তি ফিরিয়ে আনেন, তেমনি আমাদেরও দায়িত্ব অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। উদ্বাস্তুরা অপরাধী নয়, তারা পরিস্থিতির শিকার। তাদের পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত মানবতাট। এই বার্তা পুজোর আনন্দের সঙ্গে মানবতার আলোও ছড়িয়ে দেয় চারদিকে।

শুধু কথা নয়, বিশেষ উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে কমিটির তরফে। কেমব্রিজ কাউন্সিল থেকে উদ্বাস্তুদের জন্য বিশেষ তহবিল গড়ে তোলা হয়। যা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করা হবে বলে জানানো হয়েছে। পুজোর পাশাপাশি আয়োজন ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও। মঞ্চে উঠে গান শোনান প্রবাসীরা, ক্ষুদেরা কেউ আবৃত্তি পরিবেশন করে। ভিন্ন ভাষা হলেও তাদের কণ্ঠে ছিল বেদনা, আশা আর জীবনের জয়গান। দর্শকরা উপলব্ধি করেন সংস্কৃতির ভিন্নতা থাকলেও হৃদয়ের ভাষা একই।

উদ্যোক্তাদের মতে, এই আয়োজন প্রমাণ করল দুর্গাপুজো মানে শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং মানবিক দায়িত্ববোধও। যখন চারদিকে ঘৃণা, বিভাজন আর ভয় বাড়ছে, তখন কেমব্রিজের এই পুজো শিখিয়ে দিয়েছে ঐক্য, সহমর্মিতা আর মানবতার আলো দিয়েই অন্ধকার দূর করা সম্ভব। দেবী দুর্গা শক্তির প্রতীক। আজকের দিনে সেই শক্তি মানে দয়া, সহমর্মিতা ও ন্যায়বিচার।

যুদ্ধ, বৈষম্য আর উদ্বাস্তুদের চোখের জলই আজকের অসুর। কেমব্রিজের এই বছরের পুজোয় মা দুর্গার আরাধনা মিলে গিয়েছে মানবতার বাণীর সঙ্গে।এই মহৎ আয়োজনের পিছনে দীর্ঘদিনের নেতৃত্বে আছেন কমিটির প্রেসিডেন্ট বর্ণালী ঘোষ। বহু বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম ও সংগঠনের দক্ষতায় এই পুজোকে শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং প্রবাসী সমাজের ঐক্য ও মানবিকতার প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলেছেন তিনি। তাঁর হাত ধরে দুর্গোৎসব আজ সকলের জন্য উন্মুক্ত।