টেমসের তীরে মায়ের আবাহন, চিরন্তন অনুভূতির টানে ক্যামডেনের পুজোয় থিম ‘মা’

Durga Pujo 2025 : শারদপ্রাতের মেঘ-কুয়াশা ভেদ করে লন্ডনের আকাশে এক ঝলমলে রোদ। টেমসের ঢেউয়ে উৎসবের উচ্ছ্বাস। সুইস কটেজ লাইব্রেরির অন্দর থেকে ভেসে আসছে চেনা সুর- "জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী"।

Durga Puja 2025: glimpses of famous London Durga Puja
সুইস কটেজ লাইব্রেরির অন্দর থেকে ভেসে আসছে চেনা সুর- "জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী"।

আজকাল ওয়েবডেস্ক: শারদপ্রাতের মেঘ-কুয়াশা ভেদ করে লন্ডনের আকাশে এক ঝলমলে রোদ। টেমসের ঢেউয়ে উৎসবের উচ্ছ্বাস। সুইস কটেজ লাইব্রেরির অন্দর থেকে ভেসে আসছে চেনা সুর- "জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী"। আবেগে, স্মৃতিকাতরতায় কেঁপে উঠছে প্রবাসী বাঙালির মন। মা আসছেন।

সালটা ছিল ১৯৬৩। লন্ডনে তখন বাঙালির সংখ্যা হাতেগোনা। কাজ বা পড়াশোনার টানে কলকাতা ছেড়ে আসা কয়েকজন তরুণ-তরুণী ঠিক করলেন, বিদেশের এই নিস্তব্ধতা ভাঙতে চাই মায়ের আরাধনা। সুইস কটেজ লাইব্রেরির সেই ছোট পরিসরেই প্রথম বেজেছিল ঢাক, জ্বলেছিল ধূপ আর শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়েছিল প্রবাসী আকাশ। ষাট বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে সেই পুজো আজ লন্ডনের বাঙালি সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক মহীরুহ।

কোভিড অতিমারির অন্ধকারেও এই প্রস্তুতি থামেনি। সাদামাটা প্রতিমা, মুখোশের আড়াল থেকে প্রণাম আর সীমিত ভোগের আয়োজনে সেবার যেন স্বয়ং উমা নেমে এসেছিলেন টেমসের তীরে, প্রবাসী বাঙালির কাছে আশ্বাস, সাহস আর স্নেহের প্রতীক হয়ে।

প্রতি বছরই ক্যামডেনের পুজো এক একটি নতুন থিমের ছোঁয়ায় সেজে ওঠে। কখনও ইতিহাস, কখনও সামাজিক বার্তা, আবার কখনও শিকড়ের টান। সেই ধারা মেনেই ২০২৫ সালের পুজোর জন্য আয়োজকরা বেছে নিয়েছেন এক চিরন্তন অনুভূতি- "মা"।

কমিটির সভাপতি ড. আনন্দ গুপ্তের কথায়, "মা মানে শুধু প্রতিমার সামনে প্রণাম নয়। মা মানে আশ্রয়, সাহস, ভালোবাসা। এবারের থিম সেই অমোঘ অনুভূতিরই প্রতিচ্ছবি।" এই থিমকে কেন্দ্র করেই সুইস কটেজ লাইব্রেরির প্রতিটি কোণ সাজানো হচ্ছে মাতৃত্বের ছায়ায়। আলো-আঁধারির খেলায় ফুটে উঠবে উমার স্নিগ্ধ দৃষ্টি, প্রদীপের শিখায় জেগে উঠবে তাঁর স্নেহময় রূপ,

উৎসবের আনন্দধারা।

ষষ্ঠীর বোধন দিয়ে উৎসবের সূচনা। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর অঞ্জলি থেকে সন্ধিপুজো- প্রতিটি পর্বে থাকবে আলাদা রঙের ছোঁয়া। এ বারের বিশেষ আকর্ষণ হিসাবে থাকছে 'নটী বিনোদিনী' অবলম্বনে একটি নৃত্যানুষ্ঠান। মহিষাসুরমর্দিনীর সুরের সঙ্গে নৃত্যের ঝঙ্কার লন্ডনের বুকেও তৈরি করবে বাংলার চেনা আবেশ। দশমীর সিঁদুরখেলায় লাল হয়ে উঠবে সুইস কটেজের আঙিনা, বাতাসে মিশে যাবে শঙ্খ, উলুধ্বনি আর ধুনোর গন্ধ।

উৎসব মানেই ভোজন আর মিলনমেলা। ক্যামডেনের পুজো মণ্ডপেও তার ব্যতিক্রম নেই। ফুচকা, মোমো থেকে শুরু করে রসগোল্লা আর মিষ্টি দইয়ের সম্ভার নিয়ে হাজির থাকবে খাবারের স্টলগুলি। শিশুদের জন্য থাকছে বসে আঁকো প্রতিযোগিতা। প্রবাসী শিল্পীদের গান, কবিতা, নাটক আর ধুনুচি নাচে প্রত্যেকটি সন্ধ্যা হয়ে উঠবে জমজমাট।

ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন।

ক্যামডেনের পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ঐতিহ্যের সঙ্গে ঐশ্বর্যের মেলবন্ধন। শিল্পপতি লক্ষ্মী মিত্তলের পৃষ্ঠপোষকতায় এই পুজো প্রতি বছর এক আলাদা মাত্রা পায়। এ বছরও কুমোরটুলি থেকে বিশেষ বিমানে উড়িয়ে আনা হয়েছে প্রতিমা, যা শিল্প, নান্দনিকতা আর আভিজাত্যের এক অনন্য মেলবন্ধন। তবে শুধু জাঁকজমকই নয়, ক্যামডেনের পুজো প্রতি বছর মানবতার বার্তাও ছড়িয়ে দেয়। বিভেদ আর অশান্তির পৃথিবীতে মা দুর্গা হয়ে ওঠেন সমতা ও মানবতার নীরব আহ্বান।

পুজোর এই দিনগুলিতে সুইস কটেজ লাইব্রেরি যেন এক টুকরো বনেদি কলকাতা। লালপাড় শাড়ি, ধুতি-পাঞ্জাবি আর শিশুদের কোলাহলে তৈরি হয় এক অদ্ভুত আপন আবহ। প্রবাসে জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্মের কাছে এই উৎসব কেবল আনন্দের নয়, নিজের শিকড়ের সঙ্গে পরিচয়ের এক মাধ্যমও বটে।

ড. আনন্দ গুপ্ত বলেন, "মায়ের আশীর্বাদকে পাথেয় করে আমরা বাংলার শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিকে প্রবাসে ছড়িয়ে দিচ্ছি। আগামী প্রজন্ম যেন এই ধারাকে গর্বের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যায়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।"

কলকাতা থেকে হাজারো মাইল দূরে লন্ডনে যখন ঢাকের বোলে কাঠি পড়ে, তখন মনে হয়, ঘরে ফিরলাম। হয়তো এই ঘর ইট-কাঠের নয়, এ ঘর আমাদের হৃদয়ের। তাই ক্যামডেনের এবারের থিম 'মা' আসলে সেই ঘরে ফেরারই গল্প- এক চিরন্তন আবেগ, যা সময় বা দূরত্ব কিছুই মুছে ফেলতে পারে না।