রাজকন্যা বিদ্যা এবং মন্দিরের পূজারি সুন্দর-এর ভালবাসার জোর, বন্ধ হয়েছিল কালীর সামনে 'নরবলি', দিনের বেলাতেও কেউ যেতেন না
বর্ধমানের বিদ্যাসুন্দর কালীপুজোর পেছনে জড়িয়ে রয়েছে সুন্দরের প্রেমের গল্প৷ রাজার কন্যা বিদ্যা ও মন্দিরের পূজারি সুন্দরের ভালবাসার জোরে বন্ধ হয়েছিল মন্দিরের নরবলি প্রথা৷

আজকাল ওয়েবডেস্ক: বর্ধমানের বিদ্যাসুন্দর কালীপুজোর পেছনে জড়িয়ে রয়েছে সুন্দরের প্রেমের গল্প৷ রাজার কন্যা বিদ্যা ও মন্দিরের পূজারি সুন্দরের ভালবাসার জোরে বন্ধ হয়েছিল মন্দিরের নরবলি প্রথা৷
বর্ধমানের তখন মহারাজা আমল। বর্ধমানের উপকন্ঠের বেশিরভাগ এলাকা ছিল ঘন জঙ্গলে ভর্তি। বিশেষ করে দামোদর তীরবর্তী তেজগঞ্জ এলাকায় ছিল আরও গভীর জঙ্গল। সেখানেই কালী মন্দিরে পুজো অর্চনা হত নির্জনে। ওই কালী মন্দিরে কেউ তেমন যেতেন না। এটি 'মশানকালী' নামেই পরিচিত ছিল। রাজবিদ্রোহীদের নাকি এখানে এনেই চরম শাস্তি দেওয়া হত।
কথিত আছে, যারা অন্যায় অত্যাচার করত, তাদের এই মন্দিরে দেবীর সামনে হাঁড়িকাঠে নরবলি দেওয়া হত। তাই এই কালী দক্ষিণ মশানকালী নামে পরিচিত ছিল। ফলে দিনের বেলাতেও ওই এলাকা দিয়ে যাতায়াত করার কেউ খুব একটা সাহস করতেন না।
রাজার এক কন্যা ছিল, নাম বিদ্যা। আর সুদর্শন পূজারি ছিলেন সুন্দর নামে এক যুবক। সুন্দরের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। গরিব ছিলেন। ঠাকুরের ফুল দিতে আসতেন মালিনী মাসি। তিনি প্রতি ঠাকুর বাড়িতে ফুলের মালা দিতেন। যথারীতি একদিন মালিনী মাসি মন্দিরে ফুলের মালা নিয়ে এসেছেন। সেই মালা দেখে পূজারি সুন্দর খুব আকৃষ্ট হন। তিনি মালিনী মাসিকে জিজ্ঞাসা করেন, এত সুন্দর ফুলের মালা কে গেঁথেছে? যে মালা গেঁথেছে তাকে দেখার জন্য ছটফট করতে থাকেন সুন্দর। মালিনী মাসি তাঁকে বলেন, রাজকুমারী বিদ্যা মালা গেঁথেছেন। কিন্তু তাঁকে দেখা সম্ভব নয়। এই ভাবনা পরিত্যাগ করাই ভাল।
কিন্তু পরবর্তীকালে বিদ্যার সঙ্গে সুন্দরের পরিচয় হয়। তাঁদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনকী তাঁরা নাকি মন্দিরের পাশ থেকে রাজবাড়ি পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গও খুঁড়ে ফেলেছিলেন। সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে বিদ্যা ও সুন্দর একে-অপরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে যেতেন। সময় যতই গড়াতে থাকে ততই প্রেম গভীর হয় তাঁদের।
একদিন গুপ্তচরের মাধ্যমে তেজচাঁদ বিদ্যা ও সুন্দরের প্রণয়ের ব্যাপারে জেনে ফেলেন। খবরটা কানে যেতেই রাজা প্রচণ্ড রেগে যান। তিনি বিদ্যা এবং সুন্দরকে কালীর সামনে বলি দেওয়ার আদেশ দেন। রাজার হুকুমমতো তাঁদেরকে বলি দিতে নিয়ে যাওয়া হয় কালী মন্দিরে। হাঁড়িকাঠে বিদ্যা ও সুন্দর দু'জনকে ঢোকানোর আগে তাঁরা মা কালীর কাছে প্রার্থনা করেন। এরপরেই ঘটে যায় সেই ঘটনা। খড়গ হাতে বলি দেওয়ার সময় কাপালিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বিদ্যা আর সুন্দর দুই প্রেমিক প্রেমিকা মন্দির থেকে উধাও হয়ে যান। ঘটনা দেখে রাজা বুঝতে পারেন দেবী ক্রুদ্ধ হয়েছেন। আদেশ দেন নরবলি বন্ধ করার।
রাজ্যপাট না থাকলেও এখনও প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই এই কালী মন্দিরে দেবীর পুজো হয় বলে জানান সেবাইত আভা বটব্যাল। রাজবংশ থেকেই এই পুরোহিত পরিবারকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে কালের সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে অনেককিছুই। পুজোয় জাঁকজমক এখন আর আগের মতো নেই। কিন্তু লোকের মুখে মুখে ফেরে এই গল্প। যার টানে তবু কিছু মানুষ এখানে এখনও আসেন। মন্দিরের দিকে তাকিয়ে ফিরে যেতে চান সেই সময়ে। মা এখানে পাষাণ মূর্তি। নিত্যদিন পুজো হয়। সন্ধ্যা আরতি হয়।
সেবায়েত পরিবারের 'মাসীমা' আভা বটব্যাল বর্তমানে অসুস্থ। গতবছর কালীপুজো থেকেই তাঁর শরীর খারাপ। তবু এই পরিবারটি কোনোক্রমে আগলে রেখেছে এই ভুলতে বসা কাহিনির সুন্দর মন্দিরটিকে।