কবি-সাধক কমলাকান্ত, তাঁর আরাধ্যা কালী প্রতিমার পায়ে বেলকাঁটা ফুটিয়ে রক্ত বের করে দেখিয়েছিলেন, এটাই জনশ্রুতি

মৃত্যুর পর কমলাকান্তের সমাধির ওপরেই মা কালীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময় থেকেই মন্দিরে নিত্যপুজো হয়ে আসছে।

Kamalakanta the singer and worshipper of Goddes Kali did many miraculous works clam locals
বর্ধমান শহটের বোরহাটে সাধক কমলাকান্ত কালীবাড়ি।

আজকাল ওয়েবডেস্ক: বাংলা ভক্তি সঙ্গীতে রামপ্রসাদ সেনের ধারার সার্থক উত্তরসূরী কমলাকান্ত। তাঁর রচিত গান আজও লোকমুখে প্রচলিত।  শুধু মা কালীর প্রতি আত্মনিবেদন নয়, তাঁর গানে ধরা পড়েছে তৎকালীন সমাজ।

বর্ধমান শহটের বোরহাটে সাধক কমলাকান্ত কালীবাড়ি। বর্ধমানের মহারাজ তেজচাঁদ মহাতাব তাঁর প্রতি মোহিত হয়ে তাঁকে এই কালীমন্দির তৈরি করে দেন। এখানেই সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন সাধক কমলাকান্ত। মৃত্যুর পর তাঁর সমাধির ওপরেই মা কালীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময় থেকেই মন্দিরে নিত্যপুজো হয়ে আসছে। এখানে কমলাকান্ত প্রতিষ্ঠিত কালভৈরব ও পঞ্চমুন্ডির আসন আছে। দীপান্বিতা কালীপুজোয় এখানে অগণিত ভক্তের সমাগম ঘটে।একসময় কমলাকান্তর কালীসাধনার কথা জানতে পেরে তাঁকে বর্ধমানে নিয়ে আসেন  তত্‍কালীন মহারাজ তেজচাঁদ মহাতাব। সেখানে কমলাকান্তকে মা কালীর নিত্যসেবার দায়িত্ব দেন তিনি। পাশাপাশি নিজের উশৃঙ্খল পুত্র প্রতাপচাঁদকে সুপথে ফেরানোর জন্যও কমলাকান্তের দ্বারস্থ হন মহারাজ। কমলাকান্তকে বর্ধমানের বোরহাটের লাকুড্ডিতে একটি বাড়ি এবং কোটালহাটে একটি মন্দিরের জমিও দান করেছিলেন তেজচাঁদ। সে জমিতেই মন্দির স্থাপনা করে সিদ্ধিলাভ করেন কমলাকান্ত। বর্তমানে সেই মন্দির 'সাধক কমলাকান্ত কালীবাড়ি' নামেই পরিচিত। 

এই মন্দিরকে ঘিরেও অনেক কাহিনী রয়েছে। শোনা যায়, মা কালী মন্দিরে জীবিত অবস্থায় রয়েছেন তা প্রমাণ করতে মহারাজ তেজচাঁদের সামনেই কালীমূর্তির পায়ে বেলকাঁটা ফুটিয়ে রক্ত বের করে দেখান কমলাকান্ত। এমনকী, অমবস্যায় মহারাজকে কমলাকান্তকে পূর্ণিমার চাঁদও দেখিয়েছিলেন বলে লোকমুখে শোনা যায়। প্রসঙ্গত, কমলাকান্তের সময় থেকেই মন্দিরে দেবীকে দেওয়া হত মাগুর মাছের ভোগ, যা আজও বর্তমান। মৃত্যুর আগে অসুস্থ কমলাকান্তকে গঙ্গায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন রাজা। কমলাকান্ত যেতে চাননি। তারপরই দেখা যায় মাটি ভেদ করে জলের ধারা উঠে এসে পড়ছে কমলাকান্তের মুখে। কমলাকান্ত নিজে যেতে না চাওয়ায় মা গঙ্গা এসেছিলেন তাঁর কাছে, এটাই জনশ্রুতি। যে জায়গা থেকে এই জলধারা উঠেছিল সেই স্থান বাঁধিয়ে কুয়ো তৈরি করা হয়। সেই কুয়োর জল আজও গঙ্গাজল হিসেবে কাজে লাগানো হয়। সেই জল ব্যবহার করা হয় পুজো, ভোগ রান্নার কাজে।

মৃত্যুর পর মন্দিরে সমাধিস্থ করা হয় কমলাকান্তকে। তাঁর সমাধির ওপরই মায়ের বেদি। সারা বছর কষ্টি পাথরের প্রতিমার পুজো হয়। দীপান্বিতা কালীপুজোয় তিনদিন ধরে উৎসব চলে এখানে।

কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম অম্বিকা কালনার বিদ্যাবাগীশ পাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে। অর্থাৎ কমলাকান্তের আসল পদবী ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। ভট্টাচার্য ছিল তাঁদের প্রাপ্ত উপাধি। তাঁর বাবা ছিলেন মহেশ্বর ভট্টাচার্য এবং মা ছিলেন মহামায়াদেবী। শৈশবেই বাবাকে হারান কমলাকান্ত। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই ছেলেকে নিয়ে বর্ধমানের খানা জংশনের নিকটবর্তী চান্না গ্রামে নিজের বাপের বাড়িতে চলে যান মহামায়াদেবী। টোলে শুরু হয় কমলাকান্তের পড়াশোনা। তবে ছোট থেকেই গানের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল কমলাকান্তের। শ্মশানে অন্ধকারে বসে আত্মমগ্ন হয়ে গান গাইবার সময় এক অশরীরী তান্ত্রিক কাপালিক তাঁকে কালীনামে দীক্ষা দেন এবং সেই মন্ত্র জপ করতে করতে সেখানেই আনন্দময়ী নৃত্যরতা শ্যামা মায়ের দর্শন পান কমলাকান্ত। বর্তমানে কমলাকান্ত কালীবাড়ির পুজো দেখভাল করে ট্রাস্টি বোর্ড। ট্রাস্টের সভাপতি প্রশান্ত কোণার বলেন, পুজোর দিন রাত ১২টার পর ঘট এনে পুজো শুরু হয়।পুজো শেষ হতে ভোর হয়ে যায়।পুজোর পরদিন দুপুরে অন্নকূটের আয়োজন করা হয়।তৃতীয়দিন কমলাকান্তের স্বরণে কমলাকান্ত দিবস পালন করা হয়। 

এখন মন্দির দেখভাল করে একটি কমিটি। তাঁদের পক্ষে প্রশান্ত কোণার জানান, এই মন্দিরের একটা টান আছে। যার টানে ছুটে আসেন ভক্তরা। কালীপুজোকে কেন্দ্র করে আবার নতুন সমারোহে জেগে ওঠে বোরহাটের এই এলাকা।