আমেরিকার ঝরা পাতার মরসুমে মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে শরতের নীল আকাশ, সান ফ্রান্সিসকোর ‘প্রথমা’র পুজো পা রাখল পাঁচে

Durga Puja 2025: আমেরিকায় সেপ্টেম্বর,অক্টোবর হল পাতা ঝরার মরশুম। অর্থাৎ ‘ফল’ সিজন। কিন্তু বাঙালির মনের ঋতুতে আসলে যে এখন শরৎকাল।

Durga Puja 2025: celebration in San Francisco California
সান ফ্রান্সিসকোর ‘প্রথমা’র দুর্গাপুজো পা রাখল পাঁচ বছরে। নিজস্ব চিত্র।

মণিদীপা দাশ ভট্টাচার্য, সান ফ্রান্সিসকো ক্যালিফোর্নিয়া

সারা পৃথিবীর বাঙালিকে যদি একটি মাত্র বাংলা শব্দ বলতে বলা হয়, তবে সবাই বোধহয় এক বাক্যে বলে উঠবে, ‘দুর্গাপুজো’! আমেরিকায় সেপ্টেম্বর,অক্টোবর হল পাতা ঝরার মরশুম। অর্থাৎ ‘ফল’ সিজন। কিন্তু বাঙালির মনের ঋতুতে আসলে যে এখন শরৎকাল। প্রবাসের বাতাসে শিউলির গন্ধ ভেসে আসে না। কিন্তু শরতের নীল আকাশ আর শিউলির গন্ধ আমাদের বাঙালির মনের ক্যানভ্যাসেই ভেসে ওঠে বছরের ঠিক এই সময়েই। 

ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোর ‘প্রথমা’ পুজো ২০২৫ সালে পাঁচ বছরে পা রাখলো। গোটা শহর জুড়ে নিদেন পক্ষে ২৫টির উপরে দুর্গাপুজো হয়ে থাকে। যারা বহু বছর কলকাতার পুজোর আবেশ থেকে বঞ্চিত, এই শহর তাদের সেই দুঃখ নিমেষেই ভুলিয়ে দিতে পারে। ‘প্রথমা’ ক্যালিফোর্নিয়ার এমন একটি বাঙালি ক্লাব, যাদের মূল মন্ত্র হল তাদের প্রত্যেকেই সেখানে প্রথম। ঠিক যেন আমাদের ফেলে আসা কলকাতা শহরের পাড়ার কোনও পুজো। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে সান ফ্রান্সিসকো ও তার আসে পাশে থাকা বেশ কিছু বাঙালি মিলে একজোট হয়ে শুরু করেছিলেন ‘প্রথমা’র দুর্গাপুজো। প্রায় আশি ঊর্ধ্ব প্রবীণ থেকে শুরু করে খুদেরাও জোট বেঁধে নিষ্ঠা ভরে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তাদের এই পুজোকে। 

সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে, নিয়মরীতি মেনে দুর্গাপুজো করার প্রতিবন্ধকতা থাকে অনেক। প্রত্যেকের ব্যস্ত জীবন, কাজ এবং সংসার সামলে সবাই যেন অপেক্ষা করে থাকে বছরের এই বিশেষ সময়টির জন্য। শৈশবের অনুভূতির কিছু রেশ আমাদের সঙ্গে থেকে যায় আজীবন। আর ‘প্রথমা’ও এই প্রবাসে সেই আনন্দের রেশ নিয়ে প্রতিবারের মত এবারও তাদের উৎসবের আঙিনাকে সাজিয়ে তুলছে তাদের মনের মতো করে। তাদের এই বছরের পুজোর বিশেষ চমক থাকছে পুজোর প্যান্ডেলে। ‘প্রথমা’র ছোট-বড় সকল সদস্য মিলে আমাদের জন্য নিয়ে আসছে এক টুকরো বেলুড় মঠ। আমেরিকায় সবচেয়ে ব্যয়বহুল শ্রমিকের খরচ। অথচ ঠিক এই জায়গাতেই প্রথমার সকল সদস্যরা নিজেদের ব্যস্ত জীবনের থেকে সময় বার করে, মেতে উঠেছেন এই প্যান্ডেল বানানোর কাজে। 

‘প্রথমা’র প্রেসিডেন্ট শ্রীমতী দীপা মণ্ডল, আমাদের সবার প্রিয় দীপা দি। যে মানুষটাকে সবসময় দেখেছি, কীভাবে হাসিমুখে হই-হই করে সবাইকে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে। দীপাদিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই বছর পুজোর বিশেষত্ব কী? দীপাদির উত্তর ছিল, “প্রথমা পাঁচ, তাই উত্তেজনা তুঙ্গে!”

আচ্ছা মনে পড়ে, আমাদের ছোটবেলায় পুজোর আগে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ থাকত পুজোয় বিখ্যাত শিল্পীদের নতুন কী গান আসতে চলছে তার জন্য। বাঙালির জীবনে পুজোর গান যেন আজও কোনও এক হারিয়ে যাওয়া নকশি কাঁথার মত আমাদেরকে জড়িয়ে আছে। ‘প্রথমা’র পুজোতেও জড়িয়ে আছে, তাদের পুজোর গান। প্রত্যেক বছর নতুন করে আসে ‘প্রথমা’র পুজোর গান। আর পুজোর এই নতুন গান যেন হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে জোতির্ময়ী মায়ের আগমনবার্তা বয়ে নিয়ে আসে এই দূর প্রবাসে। 

দুর্গাপুজোর সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের যোগ যেন, শরৎকালের সঙ্গে শিউলির, উত্তম কুমারের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের বা হিঙের কচুরির সঙ্গে ছোলার ডালের সম্পর্ক। দূর্গাপুজো মানেই নানা স্বাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মেলা।  প্রবাসে থাকা ‘প্রথমা’র সদস্যরা কয়েক মাস ধরে পুজোর এই অনুষ্ঠানের জন্য মেতে থাকেন। পুজোর এই অনুষ্ঠানের নাচ গান আমাদের সব বাঙালিকে যেন হাত ধরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, ছোটবেলার দিনগুলোয়। অপূর্ব স্বাদের ‘প্রথমা’ সদস্যদের নিজস্ব অনুষ্ঠান থেকে, দেশ থেকে আসা বহু গুণী শিল্পীদের অপূর্ব অনুষ্ঠানে ভরে ওঠে পুজোর দিনগুলো।

আরও পড়ুন: শিউলির গন্ধ আর পলাশের ছোঁয়ায় এডিনবরার দুর্গাপুজো যেন একফালি কলকাতা

এই বছর ২৬, ২৭ ও ২৮ সে সেপ্টেম্বর, ‘প্রথমা’র পুজো অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। দেবীপক্ষের সূচনায় মহালয়ার দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় এই পুজোর অনুষ্ঠান। এক সঙ্গে মিলে মিশে, মায়ের ভোগ রান্না থেকে পুজোর কাজ, খাওয়া দাওয়া ছাড়াও ‘প্রথমা’র প্রত্যেকবারের নিবেদন থাকে প্রাঙ্গনে নাচ। সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুটি থেকে শুরু করে অশীতিপর মানুষটিও ‘প্রথমা’র প্রাঙ্গনের নাচের মাধমে এই মাতৃবন্দনা যেন বলে ওঠে, ‘এবার আমার উমা এলে আর উমায় পাঠাবো না’— আসলে শিকড়ের থেকে বহু দূরে চলে এসেও, মা দুর্গার এই আগমনে প্রথমার সবাই যেন ফিরে পেতে চায়, তার এক টুকরো ফেলে আসা চেনা ছন্দকে। তাই পুজোর এই কটা দিন ছকভাঙা নিয়মে, মাতৃবন্দনার এক আলোকময় সেতু রচনা হয়, সান ফ্রান্সিসকোর ‘প্রথমা’র পুজো মণ্ডপে। ঠিক যেন সেই শঙ্খ ঘোষের কবিতা– 

“আমাদের কথা কে-বা জানে

আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।

কিছুই কোথাও যদি নেই

তবু তো কজন আছি বাকি

আয় আরো হাতে হাত রেখে

আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।”