মাঝরাতে ভেসে আসে দেবীর পায়ের নুপুরের শব্দ, মেদিনীপুরের লচি পোদ্দারের কালীপুজো আজও বয়ে চলেছে ঐতিহ্য
মেদিনীপুর শহরের হবিবপুর এলাকায় পাঁচ শতাব্দীর ঐতিহ্য বয়ে চলেছে এক অলৌকিক বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু ‘লচি পোদ্দার’ পরিবারের কালীপুজো।

আজকাল ওয়েবডেস্ক: মেদিনীপুর শহরের হবিবপুর এলাকায় পাঁচ শতাব্দীর ঐতিহ্য বয়ে চলেছে এক অলৌকিক বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু ‘লচি পোদ্দার’ পরিবারের কালীপুজো। রহস্য, ইতিহাস আর ভক্তির আবেশে মোড়া এই পুজো আজও অম্লান, আজও ভক্তদের মুগ্ধ করে।
কথিত আছে, এই পুজোর রাতে মাঝরাতে শোনা যায় দেবীর পায়ের নূপুরের শব্দ। বহু মানুষ নাকি সেই অলৌকিক ধ্বনি নিজের কানে শুনেছেন বলেই দাবি করেন। এই কারণেই প্রতিবছর লক্ষ্মীনারায়ণ দে’র বংশপরম্পরায় হয়ে আসা এই পুজো ঘিরে মেদিনীপুর শহরে ছড়িয়ে পড়ে এক অন্যরকম মুগ্ধতা।
পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা জানান, প্রায় পাঁচশো বছর আগে স্বপ্নাদেশে শুরু হয়েছিল এই কালীপুজো। সেই বিশ্বাস, সেই নিয়ম আজও ঠিক একইভাবে মেনে চলা হয়। পরিবারের এক বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য বলেন, ‘মা এখানে অত্যন্ত জাগ্রত। আমরা নিজেরাই বহুবার শুনেছি মায়ের নূপুরের শব্দ। বিশ্বাস করি, মা আজও এই বাড়িতে বিরাজমান।’
তান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে আজও হয় এই পুজো। প্রাচীন রীতিনীতি এখনও অটুট। একসময় মা কালীকে বিসর্জনের জন্য গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হতো, এখনও সেই ঐতিহ্য বজায় আছে শুধু গরুর গাড়ির জায়গায় এসেছে ঠেলা গাড়ি।
বিসর্জনের সময় অন্ধকার রাত আলোকিত হয়ে ওঠে জ্বলন্ত মশালের আলোয়, যা আজও এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ। পরিবারের সদস্যদের কথায়, ‘আমরা পুজোর সময় ২৪ ঘণ্টা নির্জলা উপবাস থাকি। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত চলে মা’র আরাধনা।’
পুজোর প্রথম দিকের সময় পশুবলি ছিল প্রচলিত, কিন্তু ১৯৩৫ সাল থেকে শুরু হয় আখ ও কুমড়োর বলির প্রথা, যা আজও একইভাবে চলে আসছে।
‘পোদ্দার’ নামেরও রয়েছে এক চমকপ্রদ ইতিহাস। জানা যায়, তৎকালীন সময়ে লক্ষ্মীনারায়ণ দে নামে এক ধান ব্যবসায়ী স্বপ্নাদেশ পান মা কালী’র পুজো শুরু করার।
তিনি ধানের আড়ত চালাতেন বলে স্থানীয় মানুষ তাঁকে ‘পোদ্দার’ বলে ডাকতেন। সেখান থেকেই জন্ম নেয় ‘লচি পোদ্দার’ নামটি। ধীরে ধীরে তাঁর কালীপুজো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং আজ তা মেদিনীপুরের অন্যতম প্রাচীন ও খ্যাতনামা কালীপুজো হিসেবে পরিচিত।
এই পুজোয় আজও ওড়িশার শিল্পরীতির প্রভাব স্পষ্ট। দেবীর গহনা ও প্রতিমার অলঙ্কারে দেখা যায় সেই শৈল্পিক ছোঁয়া। পুজো উপলক্ষে বসে কবিগানের আসর যেমনটি হত শতাব্দী আগে। পুরনো ঝাড়বাতি, ঐতিহ্যবাহী সাজসজ্জা, মণ্ডপের নবরূপ সব মিলিয়ে এক অনন্য দৃশ্যের সৃষ্টি হয় এই সময়।
দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা পরিবারের সদস্যরাও প্রতিবছর ফিরে আসেন পৈতৃক ভিটেতে। অরবিন্দ দে ও দিলীপ দে জানান, ‘আমাদের এই পুজো শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয় এটি পরিবার, সংস্কৃতি ও ভক্তির মিলনক্ষেত্র। মা আমাদের একত্রে রাখেন, এই পুজো আমাদের ঐক্যের প্রতীক।’
স্থানীয় মানুষদের দৃঢ় বিশ্বাস, মায়ের নূপুরের শব্দ মানে আশীর্বাদের বার্তা। কেউ অসুস্থ হলে বা বিপদে পড়লে মা তাঁদের সাড়া দেন। সেই অলৌকিক বিশ্বাসেই প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান ‘লচি পোদ্দার’ বাড়ির উঠোনে।
শহরের প্রবীণ বাসিন্দা বিনোদ ঘোষ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে এই পুজো দেখছি। এমন ভক্তি, এমন শুদ্ধতা আর কোথাও পাইনি। বিসর্জনের রাতটা যেন অন্য জগতের মশালের আলোয় মনে হয় মা নিজেই পথ দেখাচ্ছেন।’
পাঁচ শতাব্দী পেরিয়ে আজও ‘লচি পোদ্দার’ বাড়ির কালীপুজো শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয় এটি মেদিনীপুরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের জীবন্ত প্রতীক। রাতের নিস্তব্ধতায় যখন ভেসে আসে সেই অদৃশ্য নূপুরের টুংটাং আওয়াজ, তখন শহরের মানুষ বিশ্বাস করেন মা আজও আছেন, আগের মতোই জাগ্রত, সজীব ও আশীর্বাদময়।