কখনও যৌনকর্মী, আবার কখনও বৃহন্নলা, মানুষ পুজো করেই দেবীর পুজো শুরু হয় এই গ্রামে

মানুষ পুজো করেই দুর্গাপুজো শুরু করেন গ্রামের মানুষরা। এমনই অভিনবত্বের সঙ্গে দশভুজাকে আহ্বান করা হয় জেলার এই পুজোয়।

Prior to starting Durga Puja firstly a living person is offered puja

আজকাল ওয়েবডেস্ক: মানুষ পুজো করেই দুর্গাপুজো শুরু করেন গ্রামের মানুষরা। এমনই অভিনবত্বের সঙ্গে দশভুজাকে আহ্বান করে আসছেন পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের অজয় নদের তীরে গোপালপুর উল্লাসপুর গ্রামের বাসিন্দারা। গত বছর যৌনকর্মীদের পুজোর মণ্ডপে এনে তাঁদের পুজো করে বিতর্কে জড়িয়ে ছিলেন এই পুজো কমিটির সদস্যরা। তার আগের বছর সাত জন বৃহন্নলাকে এনে তাঁদের পুজো করে শুরু হয়েছিল পুজো। এর পাশাপাশি কখনও কৃষক আবার কখনও শ্রমজীবী মানুষদের এনে পুজো করা হয় এই পুজোর মণ্ডপে।

এমনই অভিনবত্বের দুর্গাপুজো হয় আউশগ্রামের এই গ্রামে। জঙ্গলমহলের আদিবাসী অধ্যুষিত গোপালপুর উল্লাসপুর সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির আয়োজনে এবারও অভিনবত্বের দাবিদার। জেলার একমাত্র জঙ্গলমহলের গ্রামীণ এলাকার এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা লেখক রাধামাধব মণ্ডল। তাঁর ভাবনায় প্রতি বছরই পুজোর আয়োজনে থাকে অভিনব ভাবনা। গণদেবতার পুজো করে শুরু করা হয় মাটির মায়ের পুজো।

এই গ্রামের পুজোর থিম এবার 'বাংলার বইগ্রাম'। বইয়ের প্রচ্ছদ দিয়ে সাজানো শুরু হয়েছে পুজোর  মণ্ডপ।প্রতিমাতেও থাকছে অভিনবত্বের ছোঁয়া। অজয়ের তীরের গণ্ড এই গ্রাম বড় ধাক্কা খেয়েছিল ১১৭৬ সালের মন্বন্তরে। আগে এই গ্রামে বহু পুজো চালু থাকলেও বর্তমানে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে কালের কবলে। সেইসঙ্গে অজয়ের স্রোতধারা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে গ্রামের সেই চেনা পরিচিত দৃশ্য! এই গ্রামেই গ্রামের মহিলা, ক্ষেতমজুরদের নিয়ে পুজো শুরু করেন লেখক রাধামাধব মণ্ডল। বর্তমান সময়ের বিখ্যাত সাহিত্যিক রাধামাধব মণ্ডলের বাড়ি এই গ্রামেই।

তিনিও কৃষক, ক্ষেতমজুর পরিবারের ছেলে। ছোট থেকেই দেখেছেন নিজের গ্রামে কোনো পুজো নেই। গ্রামের সকলে পুজোর সময় হয় অন্য এলাকার ঢাকের আওয়াজ শুনে সন্তুষ্ট থাকতেন অথবা পাশের গ্রামের জমিদারদের পুজো দেখতে যেতেন। সেখানেও যে তাঁরা খুব একটা আদৃত হতেন সেটা কিন্তু নয়। এক কোণে তাঁরা গিয়ে বসে থেকেছেন। ইচ্ছে হলে তাঁদের কেউ প্রসাদ দিতেন না হলে দিতেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের দূরে দাঁড়িয়ে পুজো দেখে ফিরে আসতে হত বিষন্ন মুখে। ছেলেবেলার এইসব স্মৃতি আবেগতারিত করে তোলে রাধামাধব মণ্ডলকে। 

বুকের মধ্যে সেই চাপা যন্ত্রণা নিয়েই তিনি শুরু করেন নিজের গ্রামে দুর্গাপুজো। সেই শুরু। তারপর আর থেমে নেই। এবারও মহাসমারোহে হচ্ছে পুজো। সরকারি সাহায্য মেলে। পুজো নিয়ে লেখক রাধামাধব মণ্ডলকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, 'এক সময় বন্যা, কলেরায় আমাদের দুটি ছোট ছোট গ্রামের বহুমানুষ বীরভূমের নদী পাড়ের গ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। অনেকে মারাও যান অভাবে বা  বিনা চিকিৎসায়। ফলে গ্রামের বহু পুজো বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তা শুরু করি। আর মানুষের দানে যেহেতু হয় তাই এই পুজোতে মানুষেরই পুজো হয় প্রথম।'

রাজ্য স্তরের বহু অভিনেতা, লেখক, আমলা গ্রামের এই পুজোর উদ্বোধনে ছুটে আসেন। পুজো উপলক্ষে এবারও সাহিত্যের 'সহজ' নামের একটি পত্রিকা প্রকাশিত হবে। রাজ্যের প্রথমসারির বহু লেখক সেই পত্রিকায় কলম ধরেন। পুজোর উদ্বোধনে উপস্থিত থাকেন রাজ্য মহিলা কমিশনের সভানেত্রী লীনা গঙ্গোপাধ্যায়-সহ আরও বিশিষ্ট মানুষজনরা। 

এবার নতুন কী কী অনুষ্ঠান হচ্ছে জিজ্ঞেস করা হলে লেখক রাধামাধব মণ্ডল বলেন, 'আমাদের পুজোর পরিচালন কমিটি মহিলাদের হাতে দেওয়া আছে। রাখী মণ্ডল, তুলিকা মণ্ডল, মিতালী কর্মকার, বন্দনা ঘোষ, টুম্পা মেটে, সন্ধ্যা মেটেরা এই পুজো চালান। এবারও পুজোর উদ্বোধন হবে চতুর্থীর দিন দুপুরে। সেদিন থেকেই বাংলার নানান লোকসংস্কৃতির অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। নাটক করবেন গ্রামের মেয়েরা। এছাড়াও পুজোতে একনজরে আউশগ্রামের ঐতিহ্য, বাংলা ও বাঙালির গর্বের পাণ্ডুরাজার ঢিবিকে তুলে ধরা হবে।'