বর্গি হানার আতঙ্কে জন্ম, ঝাড়গ্রামে টিকে থাকা ৩৫০ বছরের দুর্গাপুজো

Durga Puja 2025: শহর পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে শতাব্দী প্রাচীন বনি দিওয়ানার পুজো গুলি এক একটিতে ইতিহাস যেন আনাচে-কানাচে উঁকি মারছে। তার মধ্যেই একটি শতাব্দী প্রাচীন দুর্গোৎসব এই ঝাড় গ্রামের সেন ও দাশগুপ্ত পরিবারের দুর্গাপূজা। বর্গি হানার ভয়, দেশভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল জীবনের অনিশ্চয়তা, সব কিছুর সাক্ষী থেকেও টিকে আছে এক প্রাচীন পারিবারিক দুর্গাপুজো।

Jhargram ancient durgapuja continuing for 350 years

আজকাল ওয়েবডেস্ক:  শহর পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে শতাব্দী প্রাচীন বনি দিওয়ানার পুজো গুলি এক একটিতে ইতিহাস যেন আনাচে-কানাচে উঁকি মারছে। তার মধ্যেই একটি শতাব্দী প্রাচীন দুর্গোৎসব এই ঝাড় গ্রামের সেন ও দাশগুপ্ত পরিবারের দুর্গাপূজা। বর্গি হানার ভয়, দেশভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল জীবনের অনিশ্চয়তা, সব কিছুর সাক্ষী থেকেও টিকে আছে এক প্রাচীন পারিবারিক দুর্গাপুজো। ঝাড়গ্রামের বাছুরডোবায় সেন ও দাশগুপ্ত পরিবারের এই পুজো আজও চলে আসছে একই আচার-অনুষ্ঠান মেনে।

১৭৫৪ সালের সেই দুর্দিনের কথা। বাংলার আকাশে কালো ছায়া ফেলেছিল বর্গি হামলা। ফরিদপুর জেলার ব্রাহ্মণ-দৌলতপুর গ্রামে তখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। লুট, অগ্নিসংযোগ, হানাহানি থামছিল না। সেই সময় গোপনে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন সেনগুপ্ত পরিবার। দেবীর সামনে সাজানো হতো কাঁচা কুমড়ো, কাঁচকলার সঙ্গে আঁশযুক্ত মাছ। পাশে থাকত তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা ও সুগন্ধি মশলা। ঢাক-ঢোল বাজানো যেত না, তাই নিঃশব্দেই সম্পন্ন হতো পূজা।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল বলির রীতি। ছাগ বলির পাশাপাশি চালের গুঁড়ো দিয়ে মানুষের অবয়ব তৈরি করে ‘পিটুলি’ বলি দেওয়া হতো প্রতীকী শত্রুরূপে। এই বলি অবশ্য সম্পূর্ণ হত বাম হাতে, যা আজও চলমান এক অনন্য প্রথা।

দেশভাগের সময় আবারও আঘাত নামে পরিবারে। এক কাপড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে হয় তাঁদের। অবশেষে ঝাড়গ্রামের বাছুরডোবায় নতুন করে শুরু হয় পারিবারিক দুর্গাপুজো। ১৯৪৮ সালে জ্ঞানেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এই পূজার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই সেনগুপ্ত ও দাশগুপ্ত দুই পরিবারের শাখা একত্রে এই পূজা করে আসছে।

আরও পড়ুন: ইজরায়েল প্যালেস্তাইন যুদ্ধে এবার জড়িয়ে পড়ল দুর্গাপুজোর মণ্ডপ! 'বোমা' ফাটালো বেহালা

আজও পুজোয় পরিবর্তন নেই তেমন। পঞ্চমীতে শুরু হয় পূজা। দেবীকে উৎসর্গ করা হয় কাঁচা শাকসবজি ও আঁশযুক্ত মাছ। ছাগ বলি বন্ধ হলেও তার পরিবর্তে আখ ও চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। নবমীতে বাম হাতে চালের গুঁড়োর ছোট মানুষের অবয়ব বলি দেওয়া হয়। দশমীতে দেবীকে দেওয়া হয় গন্ধরাজ লেবুর রস মেশানো সরবত, তারপর শুরু হয় বিসর্জনের আচার।

একচালার প্রতিমারও বিশেষত্ব রয়েছে। দেবীর ডানদিকে থাকেন লক্ষ্মী ও কার্তিক, আর বামদিকে সরস্বতী ও গণেশ। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী না হলেও, শাস্ত্রবিরুদ্ধ নয় বলেই জানাচ্ছেন পরিবারের পুরোহিতরা।

বর্তমান প্রজন্মের সদস্য দীপঙ্কর সেনগুপ্ত গর্বের সঙ্গে বলেন, “ফরিদপুর থেকে ঝাড়গ্রাম— আমাদের পুজোর ইতিহাস সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি। নথিপত্রে উল্লেখ আছে, বর্গি হামলার সময় ধুমধাম করে পুজো করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই দেবীকে কাঁচা শাকসবজি ও মাছ দিয়ে আরাধনা করা হতো। আজও আমরা সেই প্রথাই মেনে চলি।”

বর্গি হানার ভয়াবহতা থেকে দেশভাগের বেদনা, সেই সমস্ত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সেনগুপ্ত ও দাশগুপ্ত পরিবারের এই দুর্গাপুজো শুধু পূজা নয়, এক জীবন্ত ঐতিহ্য।