ওপার থেকে এপার, ফিরে আসা হয় চন্দ্র দর্শন করে, আজও রয়ে গিয়েছে সেই প্রথা
Durga Puja: দেবী চলে গিয়েছেন। বাক্স প্যাঁটরা গুটিয়ে কৈলাসে ফিরে গিয়েছেন গণেশজননী উমা।

আজকাল ওয়েবডেস্ক: দেবী চলে গিয়েছেন। বাক্স প্যাঁটরা গুটিয়ে কৈলাসে ফিরে গিয়েছেন গণেশজননী উমা। তিনি তো বাঙালির ঘরের মেয়ে। পুরাণের দেবী দুর্গা বাঙালির মানস প্রতিমায় রূপ পেয়েছেন উমা রূপে। তাঁর আপনভোলা শিবের মত স্বামী, চার ছেলেমেয়ের ভরা সংসার বাঙালির যৌথ পরিবার আর এককালের সমৃদ্ধির প্রতীক। বাঙালির যৌথ পরিবারের যৌথ যাপন ধরা থাকত একচালার প্রতিমায়। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এল, হল দেশভাগ।
পরিবার ছিটকে গেল। তবু আজও বাংলার বুকের ভিতর সেই যৌথ যাপনের টান উঁকি মারে। নীলকন্ঠ পাখি আজ আর ওড়ানো হয় না। দর্পণের সেই বিষাদের ছায়া কয়েকদিন রেখাপাত করবে বাঙালির মনে। চলছে বিজয়ার শুভকামনা জানাবার পালা। যুগের ধর্ম মেনে এখন তা মোবাইল ফোন হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে জনে জনে। তবুও বাঙালি এত ভাঙনের মাঝেও বুকে আগলে রেখেছে কিছু রিচ্যুয়াল বা প্রথা।
বহুযুগের সেই প্রথা ওপার বাংলা থেকে বয়ে এনেছে অন্যরকম বার্তা। একসময়ের সমৃদ্ধ গ্রামবাংলার বুকের ভিতর আগলে রাখা ভালবাসা। এমনই একটি হল সাবেকি সেই প্রথা মেনে যাত্রা বা এগিয়ে যাওয়া। এই যাত্রা হত বিজয়ার পর। পূর্ব বঙ্গের বরিশাল জেলায় এর প্রচলন ছিল বর্ণহিন্দু পরিবারে। সব হারিয়ে এ পারে এসেও মরমী মানুষদের পাশে পেয়ে আবার ঘুরে দাড়িয়েছেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ শিকড়ের টানে আগলে রেখেছেন এই যাত্রার মতো প্রথাগুলি।
বর্ধমানে দামোদরপল্লীর চৌধুরী পরিবার এমনই এক পরিবার। পরিবারের কর্তা ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিকে পাশ করে কলকাতা আসেন। দেশভাগের পর আসে গোটা পরিবার। বলা ভাল আসতে বাধ্য হয়। সেই বর্ধিষ্ণু পরিবারের সবাই কে কোথায় ছিটকে গিয়েছেন। কিন্তু প্রবোধ চৌধুরী এই প্রথা আগলে রেখেছিলেন। ১৯৯২ সালে তাঁর মৃত্যুর পর এই যাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর বড় ছেলে ২০০১ সালে আবার তা চালু করেন।
পরিবারের মেজো ছেলে শ্যামল চৌধুরী জানান, এই প্রথা শস্যভাবনার সঙ্গে জড়িত। পরিবারের সবাই সন্ধ্যায় একসাথে জড়ো হন। ভক্তিভরে দেবীকে স্মরণ করা হয়। পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য জয়ন্ত চৌধুরী জানান, সাবেকি এই প্রথায় একটি রেকাবিতে ধান, মৃত্তিকা, সোনা, রূপা, মুদ্রা, পান, সুপারি, কাচি হলুদ এবং আরো অনেক কিছু থাকে। থাকত পরিবারের সংগ্রহের রৌপ্যমুদ্রা। সেসব হারিয়ে যাওয়ার পর এখন রেপ্লিকায় কাজ সারা হয়।
পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের কন্যা স্নেহা জানান, এই সব পবিত্র দ্রব্যের আলাদা আলাদা কারণ আছে। এছাড়া বৃষ, গজ, তুরগা, দক্ষিণাবর্ত বহ্নিও পবিত্র। এগুলি গালে ঠেকানো হয়। দর্শন করা হয়। ঘ্রাণ নেওয়া হয়। দর্পণে মুখ দেখা হয়। এরপর শুরু হয় প্রণাম বা আলিঙ্গনের পালা। সবশেষে সবাই বাইরে চলে আসেন। কিছু দূর হেঁটে যান। এরপর চন্দ্রদর্শন করে ফিরে আসা হয়।
পরিবারের সূত্রে জানা গিয়েছে, এই চৌধুরী পরিবার বাংলাদেশের হবিবপুরের অধিবাসী ছিলেন। এই গ্রামের অপর নাম ছিল কেশবপুর। উর্ধতন পুরুষ রামকেশব চৌধুরীর নামে বলে প্রচলিত ছিল। বৈকুন্ঠ চৌধুরীর পুত্র প্রিয়নাথ চৌধুরী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। একই সঙ্গে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। পরিবারের একসময় স্বচ্ছলতা থাকলেও দেশভাগের আগে মোটেই আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। ওইরকম জলা পরিবেশে বালাম চালের চাষ হলেও তা খুব অপ্রতুল ছিল।
প্রিয়নাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র সংসারী হলেও ছিলেন আপনভোলা। চার পুত্র-কন্যা, স্ত্রী এবং মাকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েন দেশভাগের পর। বরিশালে দাঙ্গার পর কনিষ্ঠপুত্র একমাত্র চাকুরীজীবি। এপারে থাকা প্রবোধকুমার তাঁদের এবং নিজের মাকে নিয়ে আসেন ত্রিবেণীতে। ক্যাম্পে যেতে দেননি। রিলিফ অফিসার আত্মীয় হওয়া সত্বেও।
তাঁর আয়েই লড়াই শুরু হয় নতুন করে। দীর্ঘদিন পরে সবাই নিজের পায়ে দাঁড়ালে প্রবোধকুমার বিবাহ করেন রাণাঘাট ক্যাম্পের সুন্দরী সদ্য তরুণী লক্ষ্মীরাণীকে। প্রবোধকুমার তখন মাঝবয়সী। যাদের এতদিন আগলে রেখেছিলেন তারা সরে যায়। নতুন সংসার পাতার এই লড়াইটা প্রবোধকুমার একাই লড়েন স্ত্রীকে নিয়ে। কেউ পাশে ছিল না। একসময় চলে আসেন বর্ধমানে।কিন্তু শিকড়ের টান ভোলেন নি। প্রথাগুলিকে হারিয়ে যেতে দেন নি।
তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে এই যাত্রার মত প্রথাগুলি। সেতুবন্ধন করে রেখেছে পূর্ব আর পশ্চিমবাংলার। বাংলার অনুপম ঐতিহ্যকেও। গতবছর লক্ষ্মীরাণী চলে গিয়ছছেন। এ প্রথাপালন তাই হয়নি। পরিবার স্থান সংকুলানের কারণে চারদিকে। বিপদ এলে সবাই এক হন। বিপত্তারিনীর চলে যাবার দিনে পারিবারিক প্রথা এ বছর আবার পালিত হল এই পরিবারে।