মন্দির তৈরি হলেই ভেঙে পড়ত, রাঢ়বঙ্গের এই পুজো 'ভাঙা বাড়ি'র পুজো বলেই পরিচিত

রাঢ়বঙ্গে দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার আগে আজও বিভিন্ন গ্রামে নানারকম রীতিনীতি পালনের মাধ্যমে দেবী উমা এবং তাঁর ছেলে মেয়েদের ঘরে নিয়ে আসার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় বাঙালিদের মধ্যে।

In South Bengal this puja is known as Bhanga Barir Durga Puja
বাগডাঙ্গা বুড়িমার ভাঙা বাড়ি অর্থাৎ সিংহ বাড়িতে জীমূতবাহন দেবতার পুজোর মধ্যে দিয়ে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়

আজকাল ওয়েবডেস্ক: রাঢ়বঙ্গে দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার আগে আজও বিভিন্ন গ্রামে নানারকম রীতিনীতি পালনের মাধ্যমে দেবী উমা এবং তাঁর ছেলে মেয়েদের ঘরে নিয়ে আসার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় বাঙালিদের মধ্যে। 

মুর্শিদাবাদের কান্দি থানার অন্তর্গত বাগডাঙ্গা বুড়িমার ভাঙা বাড়ি অর্থাৎ সিংহ বাড়িতে জীমূতবাহন দেবতার পুজোর মধ্যে দিয়ে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। অনেকে বলেন জীমূতবাহন প্রাচীন বঙ্গ দেশের একজন সুবিখ্যাত ধর্ম শাস্ত্র রচয়িতা ছিলেন। তবে সিংহ বাড়িতে জীমূতবাহনকে দেবরাজ ইন্দ্র জ্ঞানে পুজো করা হয়। শাস্ত্রমতে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এই পুজো হয়। সিংহবাড়িতে জীমূতবাহন দেবতা তাঁর বাহন হাতির উপর বসে থাকেন। 

কান্দির সিংহবাড়ির এই দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক অদ্ভুত ইতিহাস। সিংহ বাড়ির অনেক সদস্য দাবি করেন, বহু বছর আগে নাকি দুর্গা ঠাকুরের মন্দির তৈরি করার চেষ্টা হলেই সেই মন্দির ভেঙে পড়তো। সেই কারণে এই পুজো 'ভাঙা বাড়ি' বা সিংহ বাড়ির দুর্গাপুজো নামে খ্যাত। তবে বহু যুগ পর বর্তমানে কিন্তু ওই বাড়িতে স্থায়ী মন্দিরেই দুর্গাপুজা করা হয়। 

সিংহ পরিবারের সদস্য সত্যব্রত সিংহ বলেন,' আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনা হয় জীমূতবাহন দেবের পুজোর মধ্যে দিয়ে। অত্যন্ত কঠোর নিয়ম-নীতির মধ্য দিয়ে প্রত্যেক বছর আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে এই পুজো করে থাকি আমরা। আর এর পরের অষ্টমী তিথিটি হলো দুর্গাষ্টমী। তিনি জানান,'জীমূতবাহনের পুজো এই বাংলায় খুব কম দেখা যায়। তবে আমাদের বাড়ির দুর্গাপুজোর অঙ্গ জীমূতবাহন দেবের পুজো।' 

শাস্ত্রমতে এই পুজো করার জন্য বাড়ির মহিলারা সারাদিন উপোস করে থাকেন। এরপর পুজো শুরুর সময় বোঁটা সমেত আটটি ফল জীমূতবাহন দেবের সামনে তৈরি হওয়া একটি ছোট পাড় বাঁধানো পুকুরে দেবতার উদ্দেশ্যে অর্পণ করেন মহিলারা এবং পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করে পুজো করেন। সদাপতি সিংহ নামে ওই বাড়ির এক সদস্য জানান,'জিতাষ্টমীর দিন জীমূতবাহন দেবের পুজোর মাধ্যমে আমাদের বাড়িতে দুর্গা পুজোর সূচনা হয়। বহু বছর আগে দেবতার সামনে একটি ছোট জলাশয় থাকত। তবে বর্তমানে সেই ছোট জলাশয়টির পাড় বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরোহিতের অনুমতি নেওয়ার পর এই পুজোর যিনি 'মোড়ল' হন তিনি বাড়ির পাশের একটি পুকুর থেকে ঘটে করে জল ভরে নিয়ে এসে জীমূতবাহন দেবের সামনে থাকা ছোট্ট পুকুরে ভরেন। তারপর বাড়ির মহিলারা সেই পুকুরে গোটা ফল দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন।'

 

পৌষালী সিংহ নামে ওই পরিবারের এক মহিলা সদস্যা জানান ,'জীমূতবাহন দেবের মূর্তির সামনে যে ছোট্ট পুকুর রয়েছে তাতে চারটি ঘাট রয়েছে। সেই ঘাটে বাড়ির মহিলাদের প্রদীপ জ্বালাতে হয়। আমাদের বাড়িতে জীমূতবাহন দেবের পুজোর মধ্যে দিয়েই দুর্গাপুজোর সূচনা হয়ে যায়।' সত্যব্রতবাবু বলেন,'জীমূতবাহন দেবের পুজো শেষে তাঁর ঘট নিয়ে গিয়ে নারায়ণের ঘরে রাখা হয়। জীমূতবাহন দেবের ঘট বিসর্জন না হলে আমাদের বাড়িতে বোধনের ঘট ভরা হয় না। এই ভাবেই আমাদের পরিবারের দুর্গাপুজোর সঙ্গে জীমূতবাহন দেবের পুজো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গিয়েছে।' সিংহ পরিবারের সদস্যরা বলেন , তাঁদের বাড়ির নাট মন্দিরেই তৈরি হয় দেবী দুর্গার মূর্তি। গ্রামের লোকেরা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে সিংহ বাড়িতে এসে উপস্থিত হন। ভক্তিভরে তাঁরা সকলে দেবীর উদ্দেশ্যে পুষ্পাঞ্জলি দেন। 

সিংহ বাড়ির সদস্যদের কথায়, সন্ধিপুজোর সময় গ্রামের সমস্ত লোক নিজেদের সাধ্যমতো জিনিস নিয়ে এসে দেবীদুর্গার উদ্দেশ্যে অর্পণ করেন। সেই দিন সিংহ বাড়ির তরফ থেকে সকলকে প্রসাদ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। ওই এলাকার যে সমস্ত বাসিন্দারা কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন তাঁরা পুজোর দিনগুলিতে আবার গ্রামে ফিরে আসেন। সিংহ পরিবারের দুর্গাপুজোয় আনন্দে মেতে ওঠেন সকলে।