দেবীর সঙ্গে পুজো করা হয় পুতুলকেও, এই পুজো পরিচিত '২২ পুতুলের দুর্গাপুজো' নামে

মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ান কাঞ্চনতলা জমিদার বাড়িতে প্রায় ৩০০ বছর আগে শুরু হওয়া দুর্গাপুজোতে দেবী উমা এবং তাঁর সন্তানদের সঙ্গে পুজো করা হয় ১১ জন দেবী এবং ১১ জন দেবতাকে। ২২ 'পুতুলের' দুর্গাপুজো নাম খ্যাত কাঞ্চনতলা জমিদার বাড়ির পুজো আজও মুর্শিদাবাদের দুর্গাপুজোর মানচিত্রে জেলাবাসীর অন্যতম আকর্ষণ।

Durga Puja 2025 Dolls and Goddess Durga are worshiped together in Murshidabad
২২ 'পুতুলের' দুর্গাপুজো নাম খ্যাত কাঞ্চনতলা জমিদার বাড়ির পুজো আজও মুর্শিদাবাদের দুর্গাপুজোর মানচিত্রে জেলাবাসীর অন্যতম আকর্ষণ

আজকাল ওয়েবডেস্ক: মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ান কাঞ্চনতলা জমিদার বাড়িতে প্রায় ৩০০ বছর আগে শুরু হওয়া দুর্গাপুজোতে দেবী উমা এবং তাঁর সন্তানদের সঙ্গে পুজো করা হয় ১১ জন দেবী এবং ১১ জন দেবতাকে। ২২ 'পুতুলের' দুর্গাপুজো নাম খ্যাত কাঞ্চনতলা জমিদার বাড়ির পুজো আজও মুর্শিদাবাদের দুর্গাপুজোর মানচিত্রে জেলাবাসীর অন্যতম আকর্ষণ। 

সঠিক সময় বলতে না পারলেও জমিদার বাড়ির অনেক সদস্যই দাবি করেন প্রায় ৩০০ বছর আগে ঢাকার বিক্রমপুরের মারুচি গ্রামে 'বসু' পরিবারে এই পুজোর সূচনা করেছিলেন রাঘবেন্দ্র রায়। পরবর্তীকালে এই পুজো স্থানান্তরিত হয় মুর্শিদাবাদের কাঞ্চনতলা গ্রামে। 

বসু পরিবারের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, একসময় এই পরিবারের সদস্যরা ঢাকার নবাবের দেওয়ান হিসেবে কাজ করতেন। দেওয়ান হিসেবে ভাল কাজের জন্য নবাবের কাছ থেকে 'বসু' পরিবার, 'রায়' উপাধি পেয়েছিল। তবে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ জেলায় নবাবী স্থানান্তরিত হওয়ার পর নবাবের দেওয়ানরাও মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। তৎকালীন মালদহ-মুর্শিদাবাদ এবং রাজশাহী জেলার সংযোগস্থলে অবস্থিত দেওনাপুর নামে একটি স্থানে নিজেদের 'জমিদার বাড়ি' তৈরি করেন। শোনা যায় সেই সময়ে বাণিজ্যের জন্য গঙ্গা নদীর উপর দিয়ে যে সমস্ত নৌকা যেত সেগুলো থেকে খাজনা আদায় করা এবং নিরাপত্তা প্রদান করে সেই টাকা বাংলার নবাবকে 'নজরানা' হিসেবে জমা দিয়ে জমিদারি পেয়েছিল 'বসু' পরিবার। 

তবে প্রত্যেক বছর বর্ষার সময় দেওনাপুরের বিস্তীর্ণ অংশ প্লাবিত হয়ে যাওয়ার কারণে পরিবারের সদস্যরা অন্যত্র নিরাপদ স্থানে তাঁদের 'জমিদার বাড়ি' সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শোনা যায় বহু বছর পূর্বে নৌকা করে জমিদারি এলাকার মধ্যে উঁচু জায়গা খুঁজতে গিয়ে তাঁরা কাঞ্চনতলার খোঁজ পান। জমিদার পরিবারের সদস্যরা যখন এলাকাটি দেখেন সেই সময়ে গোটা গ্রাম কাঞ্চন ফুলে ভরেছিল। সেই থেকে তাঁরা গ্রামের নামকরণ করেন কাঞ্চনতলা এবং সেখানেই নতুন করে জমিদার বাড়ি তৈরি করেন। কাঞ্চনতলা জমিদার পরিবারের দুই সদস্য জগবন্ধু রায় এবং ভগবতী রায়, নীল বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে চলে যেতে শুরু করলে তাঁদের কাছ থেকে সাতটি নীল কুঠি কিনে নেন এবং জমিদারি আরও বৃদ্ধি করেন। যদিও ব্রিটিশরা এই পরিবারকে কখনই 'জমিদার' হিসেবে স্বীকার করতে রাজি ছিল না। সাঁওতাল বিদ্রোহের সময়ে বর্তমান ঝাড়খণ্ডের পাকুড়কে রক্ষা করে 'রায়' পরিবারের প্রতিপত্তি আরও বাড়ে। পরিবারের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় - ব্রিটিশদের সঙ্গে এই জমিদার পরিবারের সম্পর্ক কখনই ভাল ছিল না। বহু চেষ্টার পর এই পরিবার দিল্লির দরবার থেকে নিজেদের 'জমিদারি' খেতাব ফিরে পেয়েছিল। 

জমিদার পরিবারের দশম পুরুষ সুদীপ রায় বলেন, 'প্রায় ৩০০ বছর ধরে একই রকম নিষ্ঠার সঙ্গে আমাদের পরিবারের দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। পরিবারের সদস্যরা দেশ বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন পুজোর দিনগুলিতে তাঁরা সকলে মুর্শিদাবাদের কাঞ্চনতলার বাড়িতে অবশ্যই উপস্থিত হবেন।' 

শাক্ত মতে এই জমিদার বাড়িতে দেবী দুর্গার পুজো করা হয়। সুদীপবাবু জানান ,'আমরা দেবীপুরান মতে মা দুর্গার আরাধনা করি। এখানে দুর্গা প্রতিমার সঙ্গে মোট ২২ জন বিভিন্ন দেবদেবী থাকেন। সেই কারণে অনেকের কাছে এই পুজো ২২ পুতুলের পুজো নামে পরিচিত।' জমিদার বাড়ির এই পুজোতে দুর্গা মূর্তির সবথেকে উপরে দেখতে পাওয়া যায়, মকরবাহিনী গঙ্গা দেবীকে। তার সঙ্গে মহাদেব নিজের দুই সহচর- নন্দী এবং ভৃঙ্গীকে নিয়ে উপস্থিত থাকেন। এছাড়াও দেবীর অকালবোধনকে স্মরণ করে প্রতিমার সঙ্গে থাকেন রাম-লক্ষণ। দেবী মূর্তির পাশে দেখতে পাওয়া যায় মা তারা, নরসিংহ, জয়া-বিজয়া এবং আরও একাধিক দেব-দেবীকে। 

সুদীপবাবু বলেন, 'শাক্ত মতে অনুষ্ঠিত আমাদের পুজোতে সপ্তমী, সন্ধিপুজো এবং নবমীতে পাঁঠা বলিদান প্রথা আজও চালু রয়েছে। পুজোর দিনগুলিতে আমরা দেবীর উদ্দেশ্যে অন্ন ভোগ দিই না। তার পরিবর্তে মা দুর্গাকে ফল এবং অন্যান্য জিনিস ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। প্রাচীন প্রথা মেনে আজও শতবর্ষ প্রাচীন কাঠামোতে দেবী প্রতিমা নির্মাণ হয় বাড়ির ঠাকুর দালানেই।' 

তবে কাঞ্চনতলা জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজোর অনন্য বৈশিষ্ট্য এখানে মন্ত্র ও স্তোত্র পাঠের মধ্যে দিয়ে পুজো শুরু হয় দুর্গাপুজোর আগের নবমী থেকে। তবে প্রতিমাকে বেদীতে বসানো হয় পঞ্চমী অথবা ষষ্ঠীর দিন কোনও এক শুভ মুহূর্তে। এখন প্রতিদিন দু'বেলা ঘটে পুজো হচ্ছে। 

জমিদার পরিবারের এই পুজোতে প্রজাদের জন্য সর্বদাই থাকত অবারিত দ্বার। একসময় পুজোর দিনগুলোতে 'রাজা-প্রজা' একসঙ্গে বসেই খেতেন। তবে এখন আশেপাশের গ্রামে দুর্গাপুজোর সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে জমিদার বাড়ির পুজোতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। 

সুদীপ জানিয়েছেন, 'বহু বছরের রীতি মেনে আজও দশমীর দিন ৩২ জন বেহারার কাঁধে চাপিয়ে দেবী প্রতিমাকে গঙ্গা নদীতে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।'