কাশফুলে 'অর্পণ', ৩০তম বর্ষে নাকতলা উদয়ন সংঘের পুজোয় বাঙালির চিরন্তন সুর
কাশফুলে ভেসে যাওয়া আকাশ, নীলের গায়ে ভেসে ওঠা তুলোর মতো সাদা মেঘ, দূরে বাজতে শুরু করেছে ঢাকের আগমনী তাল। শরতের হাওয়ায় ভেসে আসে উৎসবের গন্ধ। মনে পড়ে যায় সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী—অপুর চোখে দেখা সেই কাশবন, দুর্গার দৌড়, আর আকাশ ভরা আনন্দের ডাক। ঠিক সেই অনুভূতিই যেন ধরা দিল এ বছর নাকতলা উদয়ন সংঘের দুর্গাপুজোয়।

সৌরভ গোস্বামী: কাশফুলে ভেসে যাওয়া আকাশ, নীলের গায়ে ভেসে ওঠা তুলোর মতো সাদা মেঘ, দূরে বাজতে শুরু করেছে ঢাকের আগমনী তাল। শরতের হাওয়ায় ভেসে আসে উৎসবের গন্ধ। মনে পড়ে যায় সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী—অপুর চোখে দেখা সেই কাশবন, দুর্গার দৌড়, আর আকাশ ভরা আনন্দের ডাক। ঠিক সেই অনুভূতিই যেন ধরা দিল এ বছর নাকতলা উদয়ন সংঘের দুর্গাপুজোয়।
তো তম বর্ষে এবার তাদের থিম “অর্পণ”—যা একদিকে পৌরাণিক কাহিনীর গভীরতায় মোড়া, অন্যদিকে আধুনিক শহরের শিল্পচেতনার রূপায়ণ। নাকতলা উদয়ন সংঘের পুজোর সম্পাদক অঞ্জন দাস আজকাল ডট ইন-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষের অবসান ঘটে, শুরু হয় দেবীপক্ষ। ঐদিন আমরা পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে জল অর্পণ করি। তাঁরা মর্ত্যে নেমে আসেন এই অর্ঘ্য গ্রহণ করতে। তাই এবারের থিম কেবল শিল্পের প্রদর্শনী নয়, পূর্বপুরুষের প্রতি কৃতজ্ঞতারও স্মারক।”
অর্থনীতি ও উৎসবের বন্ধন
এই পুজোকে ঘিরে এবারের বাজেট প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা। স্পনসরশিপেই আসছে সমস্ত অর্থ। তবে অঞ্জন দাস খোলাখুলি জানালেন, গণেশপুজো শেষ হওয়ার কারণে মুম্বইভিত্তিক স্পনসরদের টানাটানি কিছুটা আছে। তবু আশা করছেন, আগামী দিনে সমস্যা কেটে যাবে। তিনি জানান, দুর্গাপুজো আজ আর নিছক ধর্মীয় উৎসব নয়—এটি বাংলার বৃহৎ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির এক উৎস। প্রতিবছর প্রায় ১৮০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় এই উৎসবকে ঘিরে। প্রতিমা, প্যান্ডেল, আলো, বাজার, খাবার—সব মিলিয়ে পুজো এক বিশাল সামাজিক-অর্থনৈতিক মঞ্চে পরিণত হয়েছে।
শিল্পের মায়াজাল
প্রতিমা ও প্যান্ডেলের রূপকার শিল্পী রিন্টু দাস। তাঁর নির্দেশনা মেনে কারিগররা তৈরি করেন শিল্পের এক অনন্য দুনিয়া। অঞ্জন দাস বললেন, “আমরা রিন্টুবাবুর ভিশন অনুযায়ী কাজ করি। প্রতিবারই চেষ্টা করি দর্শনার্থীদের চোখে নতুন স্বপ্ন জাগাতে।”
সমাজের জন্য ''অর্পণ''
শুধু উৎসব নয়, সারা বছর ধরেই উদয়ন সংঘ থাকে সমাজসেবায় যুক্ত। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের জন্য রক্তদান শিবির তাদের নিয়মিত কাজ। “শুধু আনন্দ নয়, আমাদের লক্ষ্য সমাজের দিকেও কিছু ফিরিয়ে দেওয়া,” জানালেন সম্পাদক।
প্রশাসন ও সহযোগিতা
প্রতিদিন প্রায় ৮-১০ লক্ষ মানুষ ভিড় জমান এখানে। তাই বাসিন্দাদের জন্য রয়েছে বিশেষ রেসিডেন্সিয়াল পাশ। স্থানীয় পুরপিতা প্রসেনজিৎ দাশ, এলাকার বিধায়ক শ্রী অরূপ বিশ্বাস, পুলিশ প্রশাসন—সবাই মিলে এই উৎসবকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরেই দুর্গাপুজোকে অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় আজ দুর্গাপুজো কেবল চাহিদা বাড়ানোর মাধ্যম নয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে। কলকাতার পুজোকে ইউনেস্কোর ইন্ট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ তালিকায় স্থান দিয়েছে বিশ্বসংস্থা। ফলে, বাংলার উৎসব এখন গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে গেছে।
নিজেদের সঙ্গে 'লড়াই'
অঞ্জন দাসের কথায়, “আমাদের আসল চ্যালেঞ্জ বাইরের কারও সঙ্গে নয়, নিজেদের সঙ্গেই। প্রতি বছর নিজেদের আগের বছরকে অতিক্রম করাই আমাদের লক্ষ্য।” কাশবনের ফাঁকে আগমনী গান বাজে, ঢাকের কাঠিতে কাঁপতে থাকে শরতের দুপুর। সেই চিরন্তন বাঙালি আবেগের সঙ্গে মিশে যায় শিল্প, অর্থনীতি আর সমাজের দায়বদ্ধতা। নাকতলা উদয়ন সংঘের এবারের “অর্পণ” তাই হয়ে উঠতে চলেছে শুধু একটি থিম নয়—একটি মেলবন্ধনের কবিতা, যেখানে আছে পৌরাণিক কাহিনীর আভাস, শিল্পের আবেশ, আর মানুষের হাতে মানুষের প্রতি ভালোবাসার অর্ঘ্য।