মানত করলে মনস্কামনা পূরণ হয়, ভক্তের ভিড় লেগেই থাকে বসিরহাটের দক্ষিণাকালীর মন্দিরে
Kali Puja: মা কালীকে এক এক দিন এক এক রকম ভোগ নিবেদন করা হয়। যেমন লুচি, চিঁড়ে, ফল, খিচুড়ি, পায়েস ইত্যাদি।
আজকাল ওয়েবডেস্ক: মানত করলে মনস্কামনা পূরণ হয়। তাই, আজও ভক্তরা ভিড় করেন বসিরহাটের সংগ্রামপুর কালীমন্দিরে। বাসিন্দাদের বিশ্বাস, মন্দিরের মা দক্ষিণাকালী জাগ্রত। তিনি ভক্তের কথা শোনেন। তাই, আজও নিষ্ঠার সঙ্গে সংগ্রামপুরের মন্দিরে মায়ের পুজো হয়। আর শক্তির আরাধনায় স্থানীয় বাসিন্দারা এক মাইলের মধ্যে অন্য কোনও কালীপুজো করেন না।
কথিত আছে, যশোরের বারো ভুঁইয়া রাজা প্রতাপাদিত্য সংগ্রামপুরে ইছামতীর নদীর তীরে মা দক্ষিণাকালীর পুজো শুরু করেছিলেন। সেই হিসাব ধরলে সংগ্রামপুরের কালীমন্দিরের বয়স সাড়ে চারশো বছরের কাছাকাছি। যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, দক্ষিণাকালীর পুজোর বয়স ৬০০ বছরের বেশি। যুদ্ধে প্রতাপাদিত্য হেরে যাওয়ার পর সংগ্রামপুর এলাকায় মুসলিমদের বসতি গড়ে ওঠে। পাশাপাশি ইছামতীর পাড়ে জঙ্গলে ঢেকে যায় রাজা প্রতাপাদিত্যের গড়ে তোলা কালী মায়ের থান। পরবর্তীকালে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় টাকির রাজ পরিবারের আতিথ্য সেরে ইছামতীর নদীপথে নৌকো বিহার করছিলেন। রাতে তিনি স্বপ্নদেশ পান, সংগ্রামপুরে ইছামতী নদীর তীরে জঙ্গলের মধ্যে দক্ষিণাকালীর (Dakshina Kali) থান রয়েছে। মা তাঁর কাছে পুজো প্রার্থনা করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সঙ্গীদের নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে অবহেলিত কালীর থানে গিয়ে পুজো দেন। কৃষ্ণনগরে ফিরে তিনি ওই মন্দির সংস্কারে উদ্যোগী হন। তিনি দক্ষিণাকালী পুজোর জন্য পাকা মন্দির স্থাপন করেন।
মন্দিরে পুজো করার জন্য বর্তমান পূজারি চক্রবর্তীদের পূর্বপুরুষদের তিনি গঙ্গাসাগর থেকে নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে চক্রবর্তী পরিবার আট শরিকে ভাগ হয়ে যায়। বংশ পরম্পরায় অবশ্য তাদের পরিবারের লোকজনেরাই সংগ্রামপুরের দক্ষিণাকালীর সেবাইত হিসেবে কাজ করে চলেছেন। পূজারিরা প্রত্যেকেই একই পরিবারের ও একই গোত্রের। এক এক জন পূজারি নয় দিন করে পুজো করেন। চক্রাকারে ঘুরতে থাকে এই রীতি। কথিত আছে, মন্দিরে মা কালীর সামনে রাখা ঘটটি সংগ্রামপুরের বাসিন্দা এক মুসলিম ব্যক্তির হাতে ধরে আসে। সেই ঘট আজও অটুট। মন্দিরে মায়ের মূর্তি কী দিয়ে তৈরি, তা অবশ্য আজও কেউ জানেন না। শতকের পর শতক ধরে মন্দিরে নিত্য পুজো হয়। সেই সঙ্গে মায়ের জন্য প্রতিদিন ভোগের আয়োজনও থাকে। মা কালীকে এক এক দিন একে এক রকম ভোগ নিবেদন করা হয়। যেমন লুচি, চিঁড়ে, ফল, খিচুড়ি, পায়েস ইত্যাদি। শ্যামাপুজো উপলক্ষে মা দক্ষিণাকালীকে আমিষ ভোগও দেওয়া হয়। যেমন চিংড়ি মাছ ও কচুশাক। পাঁঠা বলি দিয়ে মাকে কাঁচা মাংস নিবেদন করা হয়।
প্রতিবছর শ্যামাপুজোর সময় কিছু বিশেষ রীতি বা প্রথাও রয়েছে। সকাল আটটার মধ্যে মায়ের চক্ষুদান করা হয়। শিল্পী মায়ের চোখ আঁকেন। তারপর পুরোহিতরা দৃষ্টিদান করেন। সন্ধ্যায় ঘণ্টা-কাঁসর সহযোগে আরতি শুরু হয়। রাত ১০টা নাগাদ পুজো শুরু হয়। চলে সারারাত ধরে। তৃতীয় প্রহরে পুজোর পর চতুর্থ প্রহরে অর্থাৎ ভোরের দিকে পাঁঠা বলি হয়। তারপর আরতি ও পুষ্পাঞ্জলি হয়। শাস্ত্রমতে হোমযজ্ঞ করলে ঠাকুরের বিসর্জন দিতে হয়। তাই, এখানে হোমযজ্ঞ হয় না। শ্যামাপুজোর দিন দেবীর ভোগে মটরের ডাল দিয়ে ইঁচোড়ের তরকারি, কচুরমুখী, চিংড়ি মাছের তরকারি ও সাদা ভাত থাকে। আজও ভোগের তালিকার কোনও পরিবর্তন হয়নি। সংগ্রামপুরের দক্ষিণাকালীকে শ্রদ্ধা জানাতে বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় বাসিন্দারা আরও একটি রীতি পালন করেন। মন্দিরের এক মাইলের মধ্যে আর কোথাও কালীপুজো হয় না।
সংগ্রামপুর কালীমন্দিরের পরিচালন কমিটির সম্পাদক মনোজকুমার মণ্ডল বলেন, 'যশোরের বারো ভুঁইয়া প্রতাপাদিত্য আমাদের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কয়েক শতাব্দী ধরে আমরা নীতি-নিষ্ঠার সঙ্গে কালী মায়ের পুজো করে আসছি। দেশ-বিদেশের বহু ভক্ত এখানে মানত করেন। তাঁদের মনস্কামনা পূরণ হয়। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের মন্দিরের এক মাইলের মধ্যে অন্য কোথাও কোনও কালীপুজো আজও হয় না।'