এই সাধককে নিজের সাকার রূপের বর্ণনা দিয়েছিলেন স্বয়ং দেবী কালিকা!

kali kahini: প্রচলিত তথ্য বলে, কৃষ্ণা চতুর্দর্শীর এক রাতে সাধকের কাতর আর্তিতে সাড়া দিয়েছিলেন মা। স্বপ্নাদেশে কৃষ্ণানন্দ বিধান পেয়েছিলেন, রাত্রি শেষে প্রাতঃমুহূর্তে কৃষ্ণানন্দ প্রথম যে নারীকে দেখবেন, সেই মতোই হবে দেবী কালীর যথার্থ সাকার মূর্তি।

krishnananda agamavagisha was started kali puja west Bengal puja

কালী কাহিনি: ঝাড়বাতির রোশনাইয়ে ঝলমল করছে গোটা বাড়ি। বনেদিয়ানায় মোড়া সেই বাড়ির খিলান ও কড়িবর্গা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে দম্ভ। অতি আতিশার্য্যের মধ্যেও ঠাকুর দালানে এক মনে দেবী দুর্গার আরাধনায় রত এক সাধক। পুজোর মাঝেই ঘটল এক বিপত্তি।

আচমকাই দেবীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়নি বলে দাবি করলেন বাড়ির গৃহকর্তা। ত্রুটিহীন দেবী আরাধনার প্রমাণ দিতে তৎতক্ষণাত সেই পুরোহিত দাবি করলেন, প্রাণপ্রতিষ্ঠার প্রমাণ তিনি দেবেন। তবে প্রমাণ দেওয়ার পর ওই ধনী বাড়ির কেউ জীবিত থাকবেন না। কথিত আছে, পুরোহিতের প্রস্তাবে গৃহকর্তা সম্মত হলে পুরোহিত একটি কুশি দেবী প্রতিমার উরুতে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। তাতেই প্রতিমার উরু ফেটে রক্তপাত শুরু হয়।  পরমূহুর্তে মুখে রক্ত উঠে বাড়ির সকল সদস্যের মৃত্যু ঘটে। সেদিনের সেই পুরোহিত আর কেউ নন, ছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।  

                                                            কালী কাহিনি   পর্ব ২      

শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের ভূমি নবদ্বীপ, জ্ঞানচর্চার অন্যতম পীঠস্থান। সুপ্রাচীনকাল থেকে সেই নবদ্বীপ তন্ত্রের সাধন ক্ষেত্র হিসেবেও পরিচিত ছিল। তবে ইতিহাস বলে, সুদূর অতীতে শক্তিপুজো হলেও তা হত মূলত ঘটে এবং যন্ত্রে।

গৃহস্তের বাড়িতে কালীসাধনার প্রচলন ছিল না। তন্ত্র সাধনা ছিল সাধারণের কাছে বিভীষিকাময়। দেবী কালিকার অবস্থান ছিল ঘরোয়া মানুষগুলির থেকে যোজন যোজন যোজন দূরে। পণ্ডিতদের একাংশের মতে, আজ বাংলার ঘরে যে কালীমূর্তির পুজো প্রচলিত, তার হয় সূত্রপাত নবদ্বীপের তন্ত্রবিশারদ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের হাত ধরেই।


কৃষ্ণানন্দ আগামবাগীশের জন্ম নদিয়ার নবদ্বীপে । তাঁর আসল পদবি ভট্টাচার্য। তন্ত্র সাধনার আগম পদ্ধতিতে সিদ্ধিলাভ করে তিনি আগমবাগীশ উপাধি পান। জনশ্রুতি, অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।

সাকার রূপে মায়ের দেখা পেতে দেবীর কাছে আকুল আর্জিই তখন কৃষ্ণানন্দের একমাত্র সাধনা। রাতের পর রাত পঞ্চমুণ্ডির আসনে ধ্যান করেও প্রাণের অস্থিরতা কাটে না।  মা যে ভয়াল নন, বরং মাতৃ স্বরূপিণী মহামায়া, তা যে সাধারণ মানুষকে চেনাতেই হবে। তাই সাধকের একমাত্র আকুতি ছিল, দেবী স্বয়ং তাঁকে নিজের রূপে সন্ধান দিন। প্রচলিত তথ্য বলে, কৃষ্ণা চতুর্দর্শীর এক রাতে সাধকের কাতর আর্তিতে সাড়া দিয়েছিলেন মা।

স্বপ্নাদেশে কৃষ্ণানন্দ বিধান পেয়েছিলেন, রাত্রি শেষে প্রাতঃমুহূর্তে কৃষ্ণানন্দ প্রথম যে নারীকে দেখবেন,  সেই মতোই হবে দেবী কালীর যথার্থ সাকার মূর্তি। পরের দিন ভোরে গঙ্গাস্নানে বেরিয়ে কৃষ্ণানন্দ দেখলেন, এক গায়ের বধূ ঘুঁটে দিচ্ছেন। তাঁর বাঁ হাতে গোবরের মস্ত তাল।  ডান হাত উঁচুতে তুলে ঘুঁটে দিচ্ছেন সেই নারী। কৃষ্ণবর্ণা-অবিনস্ত বসনা, মুক্তকেশী সেই বধূ কৃষ্ণানন্দকে দেখে জিভ কাটতেই দেবীর কৃপার আভাস পেয়েছিলেন আগমবাগীশ।

মানসপটে সেই বধূর ছবি এঁকে সেই রূপই ফুটিয়ে তুলেন মৃন্ময়ী মূর্তিতে। মাতৃ রুপে বিভোর হয়ে এক রাতে দেবী মূর্তি গড়ে পুজো করলেন কৃষ্ণানন্দ। আগমবাগীশের দেখানো পথে বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হল মাতৃরূপে দেবী কালীর আরাধনা।

সংস্কৃত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ। ভয়কে দূর করে সংসারে দেবী কালিকাকে মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর লড়াইটা খুব সহজ ছিল না। সেইসময় কৃষ্ণানন্দর অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও সাধনার জোরেই কাপালিকদের ঘেরাটোপ ভেঙে ভয়াল দেবী কালীর রূপান্তর হয়েছিল আদরনীয়া মাতৃরূপে।

 শাক্ত-বৈষ্ণব-শৈব-গণপত্য সম্প্রদায়ের মোট ১৭০টি তন্ত্রগ্রন্থ নির্যাস সংগ্রহ করে 'তন্ত্রসার'  গ্রন্থ রচনা করেন আগমবাগীশ। এই গ্রন্থ তান্ত্রিক সাধকদের কাছে বিশেষ সমাদৃত। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের আরাধ্যা দেবী আগমেশ্বরী মাতা। আজও কৃষ্ণানন্দের সাধনস্থলে এক দিনের মধ্যেই দেবী মূর্তি গড়ে মায়ের চক্ষুদান সম্পন্ন করে কালীপুজো রীতি প্রচলিত রয়েছে।

নবদ্বীপের এই তন্ত্রবিশারদের সুযোগ্য শিষ্য ছিলেন বাংলার অন্যতম সাধক-কবি।