প্রথা ছিল নরবলির, ৫০০ বছরের পুরনো সিমলাগড়ের কালীপুজোর ইতিহাস চমকে দেবে
কালীর চরণে নরবলি দিয়ে ডাকাতি করতে বেরোত ডাকাতরা। এমনই প্রবাদ আজও মুখে মুখে শোনা যায়। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো পান্ডুয়ার সিমলাগড়ের দক্ষিনা কালী। ইতিহাসের পাতা খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে এই মন্দিরের ইতিহাস।
মিল্টন সেন, হুগলি: কালীর চরণে নরবলি দিয়ে ডাকাতি করতে বেরোত ডাকাতরা। এমনই প্রবাদ আজও মুখে মুখে শোনা যায়। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো পান্ডুয়ার সিমলাগড়ের দক্ষিনা কালী। ইতিহাসের পাতা খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে এই মন্দিরের ইতিহাস। তবে স্থানীয়দের মুখে যায় শেরশাহ জি টি রোড তৈরি করার আগে থেকেই এই পুজোর সূচনা হয়েছিল। তৎকালীন রাস্তা সংলগ্ন ওই এলাকা ছিল শ্মশান এবং জঙ্গলে ভরা। দূরদূরান্তে ছিল না কোনও জনবসতি। হাড়হিম করা পরিবেশের কারণেই মানুষ ওই এলাকায় যেতে ভয় পেতেন। ভয় পাওয়ার আরও একটি কারণ ছিল ঠ্যাঙ্গারে বাহিনীর উৎপাত। লোকশ্রুতি আছে, সেই সময় ওই ঘন জঙ্গলে মোড়া এক পুকুর ছিল পাড়ে এক কাপালিকের তালপাতার ছাউনি দেওয় ঘর। পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে ওই ঘরে, ওই কাপালিক কালির সাধনা করতেন। আজও লোকমুখে শোনা যায়, ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে ডাকাতরা ঘন জঙ্গলে এসে ওই মন্দিরে নরবলি দিত মা কালীর সামনে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এক সময় রঘু ডাকাতও ওখানে গিয়ে কালী সাধনা করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনা চলাচলের জন্য এই রাস্তার গুরুত্ব বাড়তে থাকে। তখনই স্থানীয় মানুষ ভয় কাটিয়ে ওই মন্দিরে পুজো দিতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে কালী মন্দিরের উপরে মানুষের বিশ্বাস বাড়তে থাকে। জানা গেছে, স্থানীয় লক্ষণ ভট্টাচার্যর পরিবারের আদি পুরুষের আমল থেকেই এই কালীপুজো শুরু হয়েছিল। এই কালী মন্দিরে দেবী কালিকা পূজিতা হন দক্ষিণা কালী রূপে। কয়েক শতাব্দী আগেও পাণ্ডুয়া এলাকায় সিমলাগড় নামে কোনও গ্রাম ছিল না। সমগ্র এলাকার তৎকালীন নাম ছিল হরিহরপুর। সিমলাগড় কালীর নামে এলাকার নাম হয়েছে সিমলাগড়।মন্দিরেই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এক মৃন্ময়ী কালী মূর্তি। আলাদা করে কোনও নাম ছিল না দেবী কালিকার। শ্মশানে থাকার জন্য লোকে বলত শ্মশানে কালী, আবার কেউ বলেন ডাকাত কালি।
শোনা যায়, ওই পরিবারের এক তান্ত্রিক নটোবর ভট্টাচার্য মা কালীর পুজো করতে গিয়ে দেখেন মন্দিরের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে নরমুন্ড। তখন দেবীর পুজো না করে তিনি চলে আসেন। প্রায় চারদিন পর দেবী স্বপ্নাদেশ দেন, তিনি উপোস রয়েছেন। তাঁর পুজো হয়নি। তিনি কী চান? তখন তিনি নরবলি বন্ধ করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। তখন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় নরবলি।
বর্তমানে মন্দিরে ছাগল বলি প্রথা চালু রয়েছে। প্রতিদিনই চলে মায়ের নিত্য সেবা। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন পুজো দিতে। কালীপুজোর দিন বিশেষ পুজো পাঠের ব্যবস্থা করা হয়। পূর্ণার্থীদের ভিড় উপচে পড়ে। এখনও প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী ১০৮ রকমের ভোগ নিবেদন করা হয়ে থাকে। বলি প্রথা থাকলেও, ভোগ দেওয়া হয় মাছ সহযোগে। প্রতিবছরই পুজোর এই সময় দূরদূরান্ত থেকে ভক্তের সমাগম ঘটে মন্দির চত্বরে। মনস্কামনা পূরণের জন্য অনেকেই মন্দির সংলগ্ন একটি গাছে ইটের টুকরো বেঁধে দিয়ে যান। যদিও কালের নিয়মে পাল্টেছে সব।
পরিসর বেড়েছে মন্দিরের, বেড়েছে বহরে। তালপাতায় ঘেরা মন্দির পাকা এবং স্থায়ী অবস্থায় বর্তমান। মৃন্ময়ী মূর্তি বদলেছে, পরিবর্তিত হয়েছে কষ্টি পাথরে। কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মন্দিরের বর্তমান সেবাইত দীপক কুমার ভট্টাচার্য বলেছেন, ঠিক কত বছর আগে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল, তা তিনি জানেন না। সেই বিষয়টি অনেকেরই অজানা। তবে ওই মন্দিরের মা খুব জাগ্রত। এখনও জিটি রোড দিয়ে যাওয়া-আসার সময় প্রত্যেকটি গাড়ির ড্রাইভার, মায়ের কাছে পুজো না দিয়ে যান না। কালী পুজোর দিন বিভিন্ন রকম ফল দিয়ে মাকে পুজো দেওয়া হয়। তবে সিমলাগড়ের মা সন্দেশ খেতে খুব ভালবাসেন। তাই পুজোতে সন্দেশ থাকবেই। এছাড়া মায়ের ভোগে থাকে পোনা মাছ। ভক্তরা আসেন, কারণ মন থেকে ডাকলে সাড়া পাওয়া যায়। পূর্ণ লাভ হয়। পূরণ হয় মনস্কামনাও।
ছবি পার্থ রাহা।