বাংলার এই সাধকের কণ্ঠে শ্যামাসঙ্গীত শুনেছিলেন নবাব সিরাজ উদ্দ দৌলা!

special write up on ramprasad sen puja

কালী কাহিনি: তাঁর কালী সাধনার অঙ্গ ছিল তাঁর লেখা ভক্তিগীতি। সেই ভক্তিগীতিতে বেজে উঠেছিল আপামর বাঙালির অন্তরের কথা। সাধক রামপ্রসাদের ভক্তিরসের অভূতপূর্ব আবেদনে বাংলার ঘরে ঘরে মাতৃ রূপে প্রবেশ করলেন শ্মশানবাসিনী কালী। করালবদনী হয়ে উঠেলেন শ্যামা মা।

রামপ্রসাদের সময়কালকে বাংলার ইতিহাসের পাতায় এক সন্ধিক্ষণ বলা যায়। কারণ সেইসময় সমাজে এসেছিল নানা ধরনের বিপর্যয় ও পরিবর্তন। ১৭৩৯-এর মহাপ্লাবন,  ১৭৪২ এবং ১৭৫২-এর বর্গী হানা, ১৭৫৭-এর পলাশির যুদ্ধ আর ১৭৬৯-এর মন্বন্তর। এ সবকিছুর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল বাংলার কৃষি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের ওপর। বাংলার জনমানসের এই যন্ত্রণাকে অক্ষর জ্ঞানে বেঁধে নিজের কালী সাধনায় যেন মূর্ত করে তুললেন রামপ্রসাদ।

হালিশহরের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রামপ্রসাদ সেন। ছেলেবেলা থেকেই রামপ্রসাদকে আকর্ষণ করত আধ্যাত্মিক জগৎ।  পারিবারিক প্রথানুযায়ী বিবাহের পর কুলগুরু মাধবাচার্যের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন রামপ্রসাদ ও সর্বাণী।

পারিবারিক পেশা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ছেড়ে চরম আর্থিক অনটনকে সঙ্গী করে সাধন ক্ষেত্রে পা বাড়িয়েছিলেন রামপ্রসাদ। তন্ত্রবিশারদ গুরু কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্য হিসেবে রামপ্রসাদ যে তন্ত্র জ্ঞান পেয়েছিলেন, তাতে মিশে গেল ব্রহ্মতত্ব ও কালীতত্ত্ব। ব্রহ্মময়ী শক্তির অপরূপ মাধুর্য ভেসে গেল তার ভক্তিরসের জোয়ারে। 
                              
                                                                     কালী কাহিনি      পর্ব  ৩

সংসারের তাগিদে বাগবাজারে উত্তর কলকাতার বিত্তশালী রত্ন ব্যবসায়ী দুর্গাচরণ মিত্রর সেরস্তায় কাজ নিলেন রমপ্রসাদ। সেখানেও গোল বাঁধল। রামপ্রসাদের হিসাবের খাতা ভরে উঠল ভক্তিগীতিতে। খাতায় লেখা পংক্তি দেখে বিহ্বল হলেন ব্যবসায়ী দুর্গাচরণ। রামপ্রসাদের মধ্যে থাকা ভবিষ্যৎ সাধকের সত্ত্বাকে চিনতে পেরে  তিনি রামপ্রসাদকে হালিশহরে ফিরে যেতে বলেন এবং মাসিক তিরিশ টাকা বৃত্তি সেখানে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। জনশ্রতি, রামপ্রসাদ হালিশহরে ফিরে গিয়ে মাতৃসাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন।

 রামপ্রসাদ সেন হলেন সাধক রামপ্রসাদ। পঞ্চমুণ্ডির আসনে ধ্যান হোম, যজ্ঞ করার পাশাপাশি মূর্তি তৈরি করে দেবী কালীর পুজো করতেন রামপ্রসাদ। তবে আর্থিক সংকট কখনই রামপ্রসাদের পিছু ছাড়েনি। তবু কর্তব্যপরায়ন সাধক কখনই গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে যাননি। তবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে সভাকবি হওয়ার প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখ্যান করেন সাধক। পরে কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধেই বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেছিলেন রামপ্রসাদ। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে দিয়েছিলেন 'কবিরঞ্জন' উপাধি।

এখানেই শেষ নয়, জনশ্রুতি, বাংলার নবাব সিরাজ উদ দৌল্লা বাংলার শ্যামা গান শুনতে চেয়েছিলেন প্রসাদের থেকে। রামপ্রসাদের তন্ত্রসাধনার কথা লোকশ্রুতি হলেও তন্ত্রের প্রভাবমুক্তই থেকেছে কবি সৃষ্টি। আসলে রামপ্রসাদই প্রথম কবি, যাঁর গানের পংক্তিতে ছড়িয়ে পড়েছিল মানুষের যন্ত্রণার কথা। তাই সামাজিক প্রেক্ষাপটের বিচারে সাধক রামপ্রসাদ আজও যেন সমকালের আয়না।