কেন দেবী কালিকা অনন্যা এবং ব্যতিক্রমী
সুব্রত হালদার: ভারতে সর্বাধিক পূজিত দেবতা হল দেবাদিদেব মহাদেব বা শিব। শিবের আরাধনা কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সকল স্থানে প্রাধান্য পেলেও শিবের চারণভূমি ছিল প্রধানত হিমালয় সংলগ্ন উত্তর ভারত। আর বাঙালির একান্ত নিজের দেবতা হল মা কালী। নগর থেকে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত মন্দির এবং বছরের ৩৬৫ দিন সর্বাধিক পূজিত দেবতা হলেন আমাদের কালী মা। বাংলায় সর্বাধিক পূজিত দেবতা শুধু নন, দেবী কালী মা অনন্যা নানাবিধ কারণে। শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কল্পিত শক্তিরূপী মাতৃরূপের নিদর্শন কোনোখানে নেই। এখন দেখা যাক সেগুলো কী কী। শত কারণ হতে আমার চিন্তায় প্রধান দশটি এখানে তুলে ধরলাম, কেন কালীমাতা অনন্যা?
সহস্র নাম: আমরা কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম এর কথা শুনেছি। কিন্তু কালীমাতা পূজিত হন এক সহস্র নামে। পুরাণ থেকে আধুনিক সাধকের মুখে মুখে প্রচলিত নামগুলির কিছু মাত্র এখানে উল্লেখ করছি— কালী, মহাকালী, শ্যামা, ছিন্নমস্তা, কালিকা, ভৈরবী, করালী, চামুন্ডা, তামসী, ভবতারিনী আরও কয়েক শত।
কালো রূপ: দেব-দেবী, বিশেষত দেবীর রূপ সর্বদাই শুভ্র, সুরূপা স্বর্গবাসিনী। কিন্তু কালী মা একমাত্র দেবী যার কালো রূপ সমতার প্রতীক।
চণ্ডালী রূপ: গলায় মুণ্ডমালা, হাতে খড়্গ, অসুর বিনাশী, যে আজকের দিনেও সব থেকে বেশি আরাধ্য আর প্রার্থনীয়। আর কোনও দেবী-দেবতা নেই যার এমন চামুণ্ডা বা চান্ডালী রূপের পূজা হয়।
নির্বস্ত্র: মহামায়া, যে জগৎ ধারণ করছেন তাঁকে কোনও বস্ত্র আবৃত করতে পারে না। বস্ত্রহীন আরাধ্য কালী মা অনন্যা।
পদতলে স্বামী: অসৃষ্টিশীল লাগলেও এটি একটি সৃষ্টিশীল কল্পনা। মা কালী রক্তবীজকে বধ করে যখন রুদ্র রূপে পৃথিবীতে তাণ্ডব নৃত্য করতে থাকেন, তখন দেবতাদের অনুরোধে ভগবান শিব মা কালীকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে মা কালীর পায়ের নিচে শুয়ে পড়েন । মা কালীর পা স্বামী শিবের গায়ে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি চেতনা ফিরে পান। মায়ের এই রূপ সম্পর্ক, সহনশীলতা, সহযোগিতা, সহাবস্থানের অপূর্ব মেলবন্ধন।
সাধক: বাংলায় গত কয়েক শতাব্দীতে যত মহান সাধক জন্মেছেন, তাঁরা সকলে প্রায় কালী সাধক। সাধক বামাখ্যাপা, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ দেব, ঋষি অরবিন্দ অগণিত সাধকের কথা আমরা জানি। এ ব্যাপারেও কালী অনন্যা।
সংগীত: শুধু বাংলা বা ভারতে নয়। সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ধর্মীয় সংগীত রচিত হয়েছে কালী বা শ্যামা মাকে কেন্দ্র করে, যাকে আমরা শ্যামা সংগীত বলি।
রামপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ, গিরীশ চন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে ধর্মের বেড়া পেরিয়ে কবি নজরুল সহ অসংখ্য সম্মানীয় সৃষ্টিশীল মানুষের রচিত শ্যামা সংগীত এখনও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে।
নিশি আরাধ্যা: কালী তন্ত্রবাদের দেবী। আর এই তন্ত্রসাধনার শ্রেষ্ঠ সময় হল রাত। আর কোনও দেবতার পূজা মধ্যরাতে হয় না, শুধুমাত্র কালী মাতাই এই বিষয়েও ব্যতিক্রমী ।
সর্বস্তরে আরাধ্য: একমাত্র দেবী যাকে ডাকাত দল বিপদতারিনী হিসাবে পূজা করত। সেই কারণে তাদের তৈরি বহু কালী মন্দির আজও বর্তমান যেগুলো ডাকাতি কালী মন্দির বলে আজ ও বিখ্যাত।
চিরন্তন: সবচেয়ে পুরানো আরাধ্য দেবী-দেবতাদের মধ্যে দেবী কালী অন্যতম। পুরাণ থেকে মহাভারত সব গ্রন্থেই কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। বেদে উল্লেখ আছে, মার্কণ্ডেয় পুরাণে আছে, প্রাচীন থেকে প্রাচীনতম শাস্ত্রে উল্লেখ পাওয়া যায় কালিরূপী দেবীর।
পৌরাণিক কাহিনী থেকে একবিংশ শতাব্দীর পূর্ব থেকে পশ্চিমের নারীবাদী আন্দোলনগুলি কালীকে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে। নিত্য, শাশ্বত, সনাতন, চিরায়ত, বিনাশ আর অবিনাশের এক অনন্যা রূপ মা কালী।
ধর্ম থেকে সমাজ বিদ্যা, আস্তিক থেকে নাস্তিক সকল আদর্শের গ্রহণযোগ্য রূপক এক অনন্যা নারী, মা কালী।