কলকাতা পুলিশের কর্মী হয়েও শৈশবের শিল্পী সত্ত্বায় পড়েনি ভাটা, কালী মূর্তি গড়ে মাতৃ আরাধনায় ট্রাফিক সার্জেন্ট
Kali Puja 2025: ডায়মন্ড হারবারের বাসিন্দা কৌশিক নস্কর, পেশায় কলকাতা পুলিশ একজন আধিকারিক। দিনের সিংহভাগটাই কাটে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও সিগন্যালিং সামলানোর মধ্যে দিয়ে।

গোপাল সাহা
ডায়মন্ড হারবারের বাসিন্দা কৌশিক নস্কর, পেশায় কলকাতা পুলিশ একজন আধিকারিক। দিনের সিংহভাগটাই কাটে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও সিগন্যালিং সামলানোর মধ্যে দিয়ে। নিজের পেশার কঠোরতার মাঝেও যে মানুষ সৃজনশীলতার আলো ছড়াতে পারেন, তার জীবন্ত উদাহরণ কলকাতা পুলিশের এই ট্র্যাফিক সার্জেন্ট। ডায়মন্ড হারবার ট্র্যাফিক গার্ডের এই পুলিশকর্মী টানা চতুর্থ বছর নিজের হাতে গড়েছেন এক অনন্য কালী মূর্তি—যা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
পুরো প্রতিমাটি মাটির, নেই কৃত্রিম সাজসজ্জা
এবারের কালী প্রতিমায় কৌশিকের সৃজনশীলতা যেন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। পুরো প্রতিমাটি তৈরি শুধুমাত্র মাটি দিয়ে, কোনও কৃত্রিম চুল বা শাড়ির ব্যবহার নেই। শুদ্ধতা ও মৌলিকতার এই দৃষ্টান্ত দেখে মুগ্ধ তাঁর সহকর্মীরা। কৌশিক বলেন, “আমি ছোটবেলায় আঁকা বা ক্রাফটের কাজ করতাম। কিন্তু, কোনও দিন কোথাও নিয়ম করে কোনও আর্ট কলেজ থেকে পাস করা বা কিছু কোনও দিন করিনি। ছোটবেলায় কিছু সময় আঁকা শিখেছিলাম। আসলে বছর চারেক আগে প্রতিমা তৈরি করতে গিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। শিল্পী যিনি বরাবর প্রতিমা তৈরি করতেন সেখানে কিছু কাজের ব্যাঘাত ঘটায় চার বছর আগে আমি প্রথম প্রতিমা তৈরি করি। কিছু কাজ শিখেছিলাম শিল্পীরা যে ঠাকুর বানাতো তা দেখে দেখে এবং ক্রাফটের কাজ শেখা ছিল ছোটবেলায়। সেখান থেকেই আমি গত চার বছর আগে প্রথম কালী প্রতিমা প্রথম তৈরি করি। এর পরে গত চার বছর ধরে আমিই প্রতিমা তৈরি করে আসছি। আমি চাই দেবীর রূপ হোক প্রাকৃতিক ও পবিত্র। তাই এই বছর পুরোপুরি মাটির প্রতিমা বানিয়েছি।”
দিনে ডিউটির ভার, রাতে মাটির স্পর্শ— এই দু’দিকের সমন্বয়েই জন্ম নিচ্ছে এক অসাধারণ শিল্পকর্ম।
শৈশবের নেশা ফের জেগে উঠল
কৌশিকের শিল্পযাত্রা শুরু হয়েছিল ছোটবেলায়, যখন তিনি একই সঙ্গে পুলিশ এবং শিল্পী— দু’টি পরিচয়কেই স্বপ্ন হিসেবে লালন করতেন। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর সেই নেশা চাপা পড়ে যায়। একদিন ইউটিউবে প্রতিমা তৈরির ভিডিও দেখে ফের জেগে ওঠে পুরনো ভাল লাগা। প্রথমে হাত কাঁপলেও হাল ছাড়েননি। ধীরে ধীরে নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন দেবীর রূপ, আর সেই পথচলাই আজ এক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
পরিবার ও সহকর্মীদের অকুণ্ঠ সমর্থন
পুলিশের ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও কৌশিকের পাশে আছেন তাঁর পরিবার ও সহকর্মীরা। কেউ তাঁকে মাটি সংগ্রহে সাহায্য করেন, কেউ রাতের ডিউটি সামলে এসে প্রতিমার কাছে বসে থাকেন। কৌশিক আরও বলেন, “সহযোগিতা না পেলে এই কাজ অসম্ভব। আমার পরিবার, অফিসাররা, এমনকি এলাকার মানুষও এখন এই প্রতিমার অপেক্ষায় থাকেন।”
ভক্তি, দায়িত্ব আর শিল্পের অনন্য মেলবন্ধন
প্রতিমা তৈরি শেষ হলে নিজেই পুজো দেন দেবী কালীকে, তারপর আবার ফিরে যান নিয়মিত দায়িত্বে। তাঁর এই নিষ্ঠা ও ভক্তি এখন অনেকের অনুপ্রেরণা। সহকর্মীরা বলেন, “কৌশিক শুধু ট্র্যাফিকের দায়িত্ব সামলান না, আমাদের মনও সামলান। তাঁর হাতের শিল্প আমাদের গর্ব।”
আজ কৌশিক নস্করের গল্প শুধু এক পুলিশকর্মীর নয়, বরং সেই মানুষটির, যিনি প্রমাণ করেছেন, দায়িত্ব ও ভালবাসা একসঙ্গে চলতে পারে। দিনে ট্রাফিক সিগন্যালের পাশে, রাতে মাটির ঘ্রাণে— এইভাবেই জন্ম নিচ্ছে এক নতুন দেবী প্রতিমার, সঙ্গে এক নতুন অনুপ্রেরণা।