ছাতনার জিড়রার কালী — প্রেমের শিকলে বাঁধা ছ' শ বছরের ঐতিহ্য

শিল্পী চার
বাঁকুড়ার ছাতনা অঞ্চলের জিড়রা গ্রাম আজও ধারণ করে আছে এক জীবন্ত কিংবদন্তি, এক অলৌকিক বিশ্বাস আর এক গভীর ভক্তির ইতিহাস—জিড়রার কালীপুজোয়। প্রায় ছয় শত বছরের পুরনো এই পুজো শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং এক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রক্ষা করে আসছেন স্থানীয় মানুষজন।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এই পূজার সূচনা হয়েছিল ছত্রিনা নগরী অর্থাৎ ছাতনার সামন্ত রাজাদের হাত ধরে। তখন চারপাশ ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা, সভ্যতার ছোঁয়া প্রায় ছিল না বললেই চলে। সেই সময় রাজা ও প্রজারা একসঙ্গে সেই জঙ্গল পেরিয়ে উপস্থিত হতেন কালী পুজোর জন্য। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, মা জিড়রার কালীই তাঁদের রাজ্য ও প্রজাদের রক্ষা করেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গেলেও আজও সেই বিশ্বাস, সেই রীতি-নীতি একেবারে অটুট।
প্রাচীন ধর্মীয় আচার অনুযায়ী, এখানে মা কালী পূজিতা হয় পঞ্চমুন্ডির আসনের ওপর। এই রীতিটি আজও সমানভাবে পালন করা হয়। পুজোর বিশেষ মুহূর্তে, অর্থাৎ চক্ষু দানের সময়, এখানে একটি বিশেষ প্রকার বলি দেওয়া হয়, যা বহু প্রাচীন কালের ঐতিহ্য বহন করে। এরপর কালীপুজোর রাতে শুরু হয় বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ। নানা আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সারারাত ধরে কালী আরাধনা। পুজোর দিন ভোররাত থেকেই ভক্তদের ঢল নামে মন্দির চত্বরে—প্রতিমার এক ঝলক দর্শনের জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। স্থানীয়দের কথায়, 'যে ভক্তি নিয়ে মা’কে ডাকবে, মা তার মনোবাসনা পূরণ করবেই।'
জিড়রার কালীপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মায়ের মূর্তি গঠনের রীতি। বংশ পরম্পরায় কারিগর পরিবারগুলোই এই কাজ করে আসছেন। তাঁদের বিশ্বাস, প্রতি বছর মা নিজে স্বপ্নাদেশ দেন কবে ও কীভাবে মূর্তি তৈরি করতে হবে। মূর্তি তৈরির জন্য প্রথমে পুরোহিতকে দিয়ে মাটি শুদ্ধিকরণ করা হয়। তারপর মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে শুরু হয় কাঠামো তৈরির কাজ। আশ্চর্যের বিষয় হল, এখানে কখনও কোনো ছাঁচ ব্যবহার করা হয় না। মন্ত্রধ্বনি ও ধ্যানমগ্ন ভক্তির মধ্য দিয়েই গড়ে তোলা হয় মায়ের মূর্তি। ফলে প্রতিবারই মূর্তির রূপে আসে এক অনন্য আধ্যাত্মিক আভা।
পুজো শেষে পরের দিন গ্রামের কালীপুকুরে হয় প্রতিমা বিসর্জন। তবে এখানকার এক অদ্ভুত, অথচ গভীর ঐতিহ্য আজও বজায় রয়েছে—বিসর্জনের পর প্রতিমার কাঠামো শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় মন্দিরে সারা বছর। এই রীতির পেছনে রয়েছে এক পুরনো লোককথা।
কথিত আছে, একবার কালী রাগ করে মন্দির ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর বহুদিন ধরে গ্রামবাসীরা কঠোর তপস্যা ও পুজো করে রাগ ভাঙান এবং তাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনেন। এরপর থেকে প্রতিজ্ঞা করা হয়—আর কখনও যেতে দেওয়া হবে না। তাই আজও বিসর্জনের পর প্রতিমার কাঠামো ফের মন্দিরে এনে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। এই শিকল কোনো শাস্তিমূলক প্রতীক নয়, বরং এটি প্রেমের বন্ধন, ভক্তির অটুট প্রকাশ। মা জিড়রার কালী আজও সেই প্রেমের শিকলে বাঁধা থেকে রক্ষা করছে ভক্তদের।
বছরের এই সময়ে জিড়রা গ্রাম এক উৎসবমুখর আবহে ভরে ওঠে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন প্রতিমা দর্শনে। কেউ আসেন মানত করতে, কেউবা শুধু অলৌকিক সেই শক্তির ছোঁয়া পেতে। পুজোর দিন মন্দির প্রাঙ্গণ আলোকসজ্জায়, ঢাকের বাদ্য আর শাক্ত সংগীতের সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে। গ্রামের নারীরা মাথায় প্রদীপ নিয়ে পরিক্রমা করেন, পুরোহিতরা মন্ত্রোচ্চারণে মগ্ন থাকেন, আর পুরুষেরা মায়ের নাম জপ করতে করতে সারারাত কাটিয়ে দেন।
ছাতনার জিড়রার কালীপুজো তাই শুধু একটি পূজা নয়—এটি এক ইতিহাস, এক লোকবিশ্বাস, এক আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। কালী এখানে রাগিনী, স্নেহময়ী এবং প্রেমের দেবী, যিনি শিকলে বাঁধা থেকেও স্বাধীনতার প্রতীক।