চকদিঘি ভট্টাচার্য বাড়ির মা পূজিত হন ‘দক্ষিণাকালী’ রূপে, ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী কালীপুজোয় বিশেষ আকর্ষণ ন্যাড়াপোড়া
Kali Puja 2025: শারদোৎসবের পরে আসে কালীপুজো। আর এই কালীপুজো মানেই অশুভকে বিদায় করে যা কিছু শুভ তাকে বরণ করে নেওয়া।

গোপাল সাহা
শারদোৎসবের পরে আসে কালীপুজো। আর এই কালীপুজো মানেই অশুভকে বিদায় করে যা কিছু শুভ তাকে বরণ করে নেওয়া। আর আজকের দিনেই বাংলার ঘরে ঘরে বহু মানুষ অর্থাৎ গৃহস্থরা এদিন লক্ষ্মীপুজো করে থাকেন অলক্ষী বিদায় করে লক্ষীর আগমন ঘটানোর উদ্দেশ্যে।
বাঙালির কালী পুজোর ঘটা ও আরম্বড় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে একত্রিত করে। রাজ্যের সর্বত্র শ্যামা মায়ের আরাধনা করা হয়। গ্রাম বাংলার বনেদিবাড়ির ঐতিহ্যবাহী শ্যামা মায়ের বন্দনায় যেমন থাকে আলোর রোশনাই, তেমনি আভিজাত্য এবং নিয়ম নিষ্ঠায় পরিপূর্ণ।
পূর্ব বর্ধমান জেলার সুরেকালনার নিকটবর্তী গ্রাম চকদিঘির ভট্টাচার্য বাড়ির কালী ‘দক্ষিণাকালী’ নামে পরিচিত। যার আনুমানিক বয়স প্রায় আড়াইশো থেকে তিনশো বছর। বর্তমানে এটি এক প্রকার সর্বজনীন কালীপুজোয় পরিণত হয়েছে। চকদিঘি গ্রামের বনেদি পুজোর এক ঐতিহ্য বহন করছে ভট্টাচার্য বাড়ির পুজো। এই পুজোর উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে পরিবার ও গ্রামের মহিলা ব্রিগেড।
বাংলায় এই পুজোর বয়স ৭৭ বছর হলেও অবিভক্ত বাংলায় বর্তমানে বাংলাদেশের ফরিদপুরে এই পুজোর শুরু হয়। বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার সময় থেকেই এই পুজোর প্রচলন হয়ে আসছে বলে জানা যায়। এই পুজো ঘিরে ইতিহাসও নেহাত কম নয়। ভট্টাচার্য বাড়ির গৃহকর্তা প্রীতিময় ভট্টাচার্য এবং জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের কথা অনুযায়ী, আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে ১৯৫৫ সালে এই পুজো আর্থিক অনটনের কারণে বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। পরিবারের মতে মায়ের স্বপ্নাদেশে পুজো ফের চালু হয়। তবে পরিবারের একাংশের মতে, মা নিজেই আবির্ভূত হয়ে টাকার উৎসের যোগান দিয়ে এবং গোটা ব্যবস্থাকে পরিচালনার মাধ্যমে এই পুজোকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
পরিবারের এক সদস্যদের কথা অনুযায়ী, পারিবারিক পরিস্থিতির কারণে বহুবার পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা পর্যন্ত হয়েছিল। কিন্তু যখনই বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি হয় অথবা কেউ আলাদা করে পুজো করার সিদ্ধান্ত নেন, তারপরই পরেই পরিবারের কোনও না কোনও সদস্যের ক্ষতিসাধন হয়েছে। এক সদস্যের আকস্মিক মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু বর্তমানে সমস্ত মতভেদ এবং বিতর্ক অতীত। শুধু বাংলার বাইরে অর্থাৎ রাজ্যের বাইরেই নয় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এবং দেশের বাইরেও থাকা সদস্যরা এই পুজোর দিন একত্রিত হন। এই পুজো ঘিরে একান্নবর্তী পরিবারের চিত্রটা আজও বহমান। পরিবারের সদস্যদের মতে, সদস্যরা সকলেই যথেষ্ট সচ্ছল এবং প্রভাব প্রতিপত্তিপূর্ণ। আজকের এই দিনে তারা দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে একত্রে মিলিত হন এই শ্যামা পুজোকে কেন্দ্র করে।
পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠ সদস্য বারীন ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এই পুজোর যে রীতিনীতি এবং নিয়মাবলী তা অবিভক্ত বাংলার সময়কালে যে প্রথা চলে আসছিল তাই মেনেই চলছে। পুজোর পুরোহিত তিনি ও বংশপরম্পরায় এবং যিনি ঠাকুর বানান তিনিও বংশপরম্পরায় একই রকম ভাবে এই পুজোর কর্মকাণ্ডে একটি অংশ হয়ে রয়েছেন। তবে অতিমারির কারণে পুরোহিত পরিবর্তন ঘটেছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয়, গ্রামের এই পুজো ঘিরে যেমন রয়েছে গ্রামবাসীদের মধ্যে উন্মাদনা এবং এক প্রকার মিলনোৎসব। পাশাপাশি এই পুজোর সন্নিকটে হয় ন্যাড়াপোড়া, যা হয়ে থাকে দোল উৎসবের আগের দিন। স্থানীয়দের মতে এই রীতি প্রচলিত বহু বছর ধরে। কারণ ‘অলক্ষ্মী’কে বিদায় করে লক্ষ্মীদেবীর আগমন এবং একই সঙ্গে ফসলের ক্ষতি রুখতে অর্থাৎ এই সময় যে ‘কালিপোকা’র উৎস তাকেও সমুলে বিনাশ করতে এই ন্যাড়াপোড়ার প্রচলন।
বাড়ির এক গৃহবধূ কুহেলী ভট্টাচার্য বলেন, “আমি চকদিঘিতে বউ হয়ে এসেছি আজ ১৪ বছর হল। তখন থেকেই এই জায়গার পুজোর সঙ্গে আমার এক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রতি বছরই এই বিশেষ দিনটার জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করে থাকি। এখানকার ঠাকুরের মাহাত্ম্য সত্যিই অপরিসীম। বিশ্বাস করা হয়, মন থেকে কিছু চাইলে মা সেই ইচ্ছে পূরণ করেন।”
তিনি আরও বলেন, “এই পুজোর সঙ্গে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার যোগ আছে, যা আমাদের বড়রা শুনিয়েছেন। আজও সেই সব কাহিনি শুনলে গা শিহরিয়ে ওঠে। আর এই ইতিহাস শুনলে এই পুজোর পবিত্রতা ও গুরুত্ব কতটা গভীর তা বোঝা যায়। চকদিঘির পুজো শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক উৎসবও বটে। এখানে গ্রামের সব মানুষ একসাথে মেতে ওঠে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে এই মাহাত্ম্য দেখতে ও ঠাকুরের দর্শন পেতে। প্রতি বছর এই সময়টা আমাদের জীবনের আনন্দময় অধ্যায় হয়ে ওঠে। পুজোর দিনগুলোয় চারিদিক আলোয়, ঢাকের তালে, ভক্তির সুরে ভরে যায়।”
তিনি এই পুজোর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, “আমরা সবাই মনে করি, চকদিঘির ঠাকুর আমাদের রক্ষা করেন, আশীর্বাদ দেন, আর আমাদের জীবনে শান্তি এনে দেন। এই পুজো শুধু ঐতিহ্য নয়, এটা আমাদের অনুভূতির, বিশ্বাসের আর একাত্মতার।”