লন্ডনে কালীবাড়ি থেকে সংস্কৃতি ক্লাব: বিদেশের মাটিতেও জমজমাট দীপাবলি উদযাপন
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ব্রিটেনের আকাশ যেন বেশি আবেগঘন। কনকনে ঠান্ডার আগে শেষ উৎসব। রাস্তা ফাঁকা, বন্ধ দোকান। হঠাৎ কানে আতশবাজির আওয়াজ। আলোয় ঝলমলে লন্ডনের আকাশ। পটকা ফাটার আনন্দ এবার ভাসছে শহর। দূরে কোথাও ধূপের গন্ধ। আর মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ 'জয় মা কালী।'
সুমনা আদক: অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ব্রিটেনের আকাশ যেন বেশি আবেগঘন। কনকনে ঠান্ডার আগে শেষ উৎসব। রাস্তা ফাঁকা, বন্ধ দোকান। হঠাৎ কানে আতশবাজির আওয়াজ। আলোয় ঝলমলে লন্ডনের আকাশ। পটকা ফাটার আনন্দ এবার ভাসছে শহর। দূরে কোথাও ধূপের গন্ধ। আর মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ 'জয় মা কালী।'
লন্ডন কালীবাড়ির পুজো এবছর ১৪ বছরে পড়লো। এইভাবেই প্রতি বছর বিদেশের মাটিতে জেগে ওঠে বাংলা দীপাবলি, দিওয়ালি, গড়বা একসঙ্গে। আজকের গল্প সেই দুই পুজোকে নিয়ে। প্রবীণ আর নবীন 'লন্ডন কালীবাড়ি' ও 'সংস্কৃতি ক্লাব'। যাদের ভালবাসা আর বাঙালিয়ানায় একসূত্রে বাঁধা পড়েছে কুমারটুলির শ্যামা মা।
১৯৮২ সালের এক ঠান্ডার সন্ধ্যায় ভাড়াবাড়ির ছোট ঘরে কৃষ্ণা ঘোষ টেবিলের ওপর রাখলেন মায়ের ছবি, পাশে ফুল, ধূপকাঠি। ঠোঁটে মন্ত্র, চোখে আলো। মুহূর্তেই যেন বদলে গেল চারপাশ। জন্ম নিল লন্ডনের প্রথম কালীপুজো। কৃষ্ণা দির ইচ্ছে ছিল, দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও যেন কেউ না ভোলেন নিজের রীতিকে, সভ্যতাকে।
গুটি কয়েক মানুষ এসেছিলেন সেদিন। কেউ ধুনুচি ধরেছেন, কেউ ভোগ রান্না করছেন, কেউ বা ঢাক বাজানোর চেষ্টা করছেন। বছর ঘুরতে ঘুরতে সেই ছোট আয়োজন ছড়িয়ে পড়ল সাউথ লন্ডনের প্রান্তে প্রান্তে।কৃষ্ণা দির তৈরি পুজো আজকের প্রজন্ম শান্তনু, সুহানা, সিবাজীর কাছে বাড়ির পুজোর মতো। হাতে আল্পনা, রঙ্গোলি সবেতেই তাঁরা প্রস্তত। ধর্ম, ভাষা ভুলে সবাই এই পুজোতে মায়ের সন্তান। 'লন্ডন কালীবাড়ি' এখানেই মৌলিক।
'নারীশক্তি', 'প্রকৃতির পূজা', আবার 'প্রবাসীর মা', সব নিয়ে কালীবাড়ি তৈরি করে থিম, নিজেদের আয়োজনে। 'গ্রিন পুজোও' হয়েছে এখানে। যা ছিল সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। ২০১৬ সালের 'মায়ের চিঠি' যা পাড়ি দেয় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে। আজ চার দশক পর 'লন্ডন কালীবাড়ি' এক ঐতিহ্য প্রতিটি ঢাকের তালে। ছোট ঘর কমিউনিটি হলে রূপান্তরিত আজকে।
সময়ের সঙ্গে প্রজন্মরা বদলায়। বাঙালি থেকে ইংরেজি ভাষায় কথা বলা কিন্ত আচরণ থাকে পুরাতনই। সেই টান থেকেই জন্ম নেয় 'সংস্কৃতি ক্লাব'। ২০১২ সালে কয়েকজন প্রবাসী বাঙালিদের হাতে তৈরি পুজোটা বাস্তব এখানেই লন্ডনের বড়ো কালীপুজো হিসাবে সুনাম ছড়িয়েছে।
৫০ জন দর্শনার্থী নিয়ে তৈরি হলেও, আজ হাজার মানুষ ভিড় জমায় এই সংস্কৃতির মণ্ডপে। ভোগ রান্না থেকে আলপনা, মণ্ডপ সাজানো সবেতেই 'সংস্কৃতি ক্লাব' নামটি ছড়িয়ে পড়েছে সারা লন্ডনবাসীদের মুখে মুখে।
শ্যামা প্রতিমা এসেছে কলকাতার কুমারটুলি থেকে। মাটির গন্ধে ভরা সেই প্রতিমা যখন লন্ডনের আলোয় দাঁড়ায়, মনে হয় মা নিজে এসেছেন সন্তানদের আশীর্বাদ দিতে। খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পায়েসে ভরে ওঠে প্লেট। অচেনা মানুষও পুজোতে এলে হয়ে ওঠেন বড্ড আপন। নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তি নিয়ে কিংশুক বসু, সোমনাথ দারা ব্যস্ত থাকেন। 'সংস্কৃতি ক্লাব'-এর সোমনাথ বলেন, 'আমরা শুধু দেবীকে পুজো করি না, আমাদের শিকড়কেও বাঁচিয়ে রাখি।'
লন্ডনের কালীপুজো মানে শুধু ধর্মীয় আচার নয়। এক মানবিক উৎসব। যেখানে মিলেমিশে যায় বিশ্বাস, সংস্কৃতি আর হৃদয়ের টান। রাত গভীর যত, এখানের আকাশে আতশবাজির আওয়াজ, ঝলকানি ততই বাড়ে। সঙ্গে দূরে ঢাকের আওয়াজে ভেসে আসে আরতির সুর।
একদিকে 'লন্ডন কালীবাড়ি'র চার দশকের ঐতিহ্য, অন্যদিকে 'সংস্কৃতি ক্লাবে'র তরুণ উদ্যম। বয়স আলাদা, কিন্তু উদ্দেশ্য এক। প্রতিমার মুখ বড়োই মায়াবী যেন মৃদু হেসে বলছেন, 'দেশের বাইরে থেকো, তবু আমার আলো তোমাদের হৃদয়ে থাকুক।' সেই আলোই ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি প্রবাসীর ভালবাসায়।