অ্যাম্বারগ্রিস
একটা কাস্তে নিয়ে উঠোনের আগাছাগুলো পরিষ্কার করছে মীরা । রুক্ষ্ম ,উসখো খুস্ক চুল । পুরনো , ছেড়া নাইটির উপর গামছা জড়িয়ে নিয়েছে। ঘড়িতে বেলা দুটো বাজে । মীরা একবার টিনের দরজাটার দিকে তাকাল।
কাকলি দেবনাথ
একটা কাস্তে নিয়ে উঠোনের আগাছাগুলো পরিষ্কার করছে মীরা । রুক্ষ্ম ,উসখো খুস্ক চুল । পুরনো ,ছেড়া নাইটির উপর গামছা জড়িয়ে নিয়েছে। ঘড়িতে বেলা দুটো বাজে । মীরা একবার টিনের দরজাটার দিকে তাকাল । দরজাটা ভেজানো যায় না । কাঠের হুড়কো দিয়ে ঠেস দিতে হয় । একটু হাওয়া দিলেই পাল্লা খুলে যায় । এখনো খুলে আছে । মীরার দরজাটা আটকাতে ইচ্ছে করছে না। ওখান দিয়ে মাঝে মাঝে হালকা হাওয়াও আসছে । ঘামে ভেজা শরীরে একটু শীতলতার পরশ ।
“বাড়িতে কেউ আছেন ?” দরজায় ঠক ঠক শব্দ ।
মীরা দেখল , দুজন ভদ্রবেশী যুবক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ।
চটপট উঠে দাঁড়াল । গামছাটা ভাল করে সারা শরীরে জড়িয়ে নিল । কাস্তেটা মাটিতে রেখে বলল ,” কাকে চাই ? “
“মিঃ ব্যানার্জী আছেন ?”
“না , উনি তো অফিসে গেছেন ।“
“তাহলে বাড়ির কাওকে ডেকে দাও ।“
মীরা এক মুহূর্ত কপাল কুঁচকে কী যেন ভাবল । নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এসেই মিলিয়ে গেল । গায়ে জড়ানো গামছার কোণ আঙুলে পেচাতে পেচাতে বলল, “ বাড়িতে কেউ নেই । আমি এ বাড়িতে কাজ করি । “
ভদ্রলোক দুজন নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়া চাইয়ি করে , ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে বলল ,” ব্যানার্জীবাবুকে এটা দেওয়ার ছিল ।“
মীরা ইতস্তত হয়ে বলল, “ ওখানে রেখে দিন । উনি এলে দিয়ে দেব । “
একজন যুবক খামটা বারান্দায় মোড়ার উপরে রাখল ।
অন্যজন বলল ,” অবশ্যই মনে করে দিয়ে দিও ।“
যুবক দুজন বেরিয়ে যেতে মীরা একা একাই হো হো করে হেসে উঠল । ওরা সত্যি সত্যিই তাকে এ বাড়ির কাজের মেয়ে ভেবেছে । হাত ধুয়ে বারান্দায় বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো প্যারা ওঠা আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল । মনে মনে বলল, অত সুন্দর বাবার এমন কালো কুৎসিত মেয়ে হতে পারে ? ভাবতে ভাবতে চোখের দুকোণ ছলছল । বুকের ভেতর থেকে কাঁপতে কাঁপতে গরম নিশ্বাস বেরিয়ে এলো । মীরা এবার কাস্তে হাতে ঝপাঝপ আগাছা পরিষ্কার করছে , বুকের সমস্ত জ্বালা যেন আছড়ে ফেলছে সে ।
( দুই)
আজকাল একা থাকলেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে । মা রাগ করে শুয়ে আছে । বাবা না খেয়ে অফিসে চলে গেছে ।
“ আমি কিছুতেই ওই গণ্ডগ্রামে গিয়ে থাকতে পারব না । তুমি মীরাকে নিয়ে যাও । অরু আর নীরুকে নিয়ে আমি এখানে থাকব । “ ঝগড়ার সময় মায়ের বলা কথাগুলো মীরার মনের ভেতর আঁচড় কাটে ।
এই গ্রামের স্টেশনে যখন পৌছেছিল তখন বেলা বারোটা । স্টেশনে নেমে ডিম-ভাত খাইয়েছিল বাবা । গ্রামের রাস্তা … দুপাশে ধানের জমি । বর্ষাকাল হওয়ায় রাস্তায় কাদা । এত কাদা যে রিক্সাওয়ালাও আসতে চায় নি ।
মীরাকে ঘরে রেখে বাবা চলে গিয়েছিল অফিসে । বলেছিল ,”আজই রিপোর্ট করতে হবে । তুই হাত মুখ ধুয়ে রেস্ট নে ।“
বাবা অফিসে চলে যাবার পর ভয় করছিল মীরার । বড় বড় তেঁতুল গাছ , বেল গাছ, নিম গাছে ঘেরা পুরোনো কোয়ার্টার । চারিদিকে স্যাঁতসেঁতে ছায়া ছায়া ভাব । হাওয়ায় পাতা নড়লে মনে হচ্ছে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে । বাথরুমে মুখ ধুতে গিয়ে আঁতকে উঠেছিল । শ্যাওলা ধরা বাথরুমে বড় একটা গিরগিটি । ‘মাগো’ বলে চিৎকার করে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল । বাইরে দাঁড়িয়ে ভয়ে ঠকঠক করে কেঁপেছিল । কিন্তু কতক্ষণ ! খানিক ক্ষণ পরে সাহস সঞ্চয় করে আবার বাথরুমে ঢুকে ছিল । ততক্ষণে গিরগিটিটা চলে গেছে । ভয়কে জয় করে ঘৃণ্য জিনিসের সঙ্গে বসবাসের জীবন , সেইদিন থেকেই শুরু হয়েছিল মীরার ।
(তিন)
কথায় আছে যৌবনে কাকও সুন্দর । সেখানে মীরা তো এক জলজ্যান্ত মেয়ে । গায়ের রং কালো , নাক,চোখ টানাটানা নয় । কিন্তু শরীর ! সেখানে তো উপচে পড়া যৌবন ! কিছুদিনের মধ্যেই মীরা বুঝেছিল, সে অরক্ষিতা । প্রথম প্রথম অজানা ভয়ে বুক দূর দূর করত । বাবা অফিসে চলে গেলে কিভাবে নিজেকে সামলাবে বুঝতে পারত না । মায়ের কথা খুব মনে পড়ত । অভিমান হত । মা নিজের সন্তানের সঙ্গে এত নির্দয় হয় কী করে ? মায়ের ভালোবাসাও কী সন্তানের রূপের উপর নির্ভর করে ! সুন্দরী নীরুকে আগলে রাখতে মা ওকে সামনের দোকানেও একা যেতে দেয় না । অথচ মীরা সুন্দর নয় বলে কত সহজে তাকে একা ছেড়ে দিল । ইচ্ছে হত বিদ্রোহ করতে । সে যে একেবারে চুপচাপ থাকত তা নয় । কখনো কখনো প্রতিবাদ করত কিন্ত শেষ অবধি হেরে যেত । একবার নয় বারবার হেরে যেত । এখন মীরা তার হেরে যাওয়া নিয়েই নতুন এক খেলায় মেতেছে । এই খেলায় শুধুই মীরার জিত । এই জিতকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে সে। ঠিক যেভাবে শীতকালে রোদ্দুরে বসে কদবেল মাখা উপভোগ করে । মাঝে মাঝে টকে এক চোখ বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু ফেলতে ইচ্ছে করে না । জিভ দিয়ে ‘ট্য’ করে শব্দ করে আর চেটে চেটে খায় ।
এখন পুরুষের চাউনি দেখলেই মীরা বুঝতে পারে কোন পুরুষ কী চায় । পুরুষ শব্দের সঙ্গে বীর , সাহসী ,সৎ এই বিশেষণগুলি কেমন যেন বেমানান লাগে ।
প্রত্যেক মেয়ের মত মীরার জীবনেও প্রথম পুরুষ তার বাবা । কিন্তু সেই বাবাকেও দেখেছে মায়ের ভয়ে কেমন মিইয়ে থাকতে ।
এই গ্রামে এসে পরিচয় হল শিবুদার সঙ্গে । ও ছিল পাড়ার দাদা । কারো কোনও বিপদ হলেই ঝাঁপিয়ে পড়ত । একা ঘরে মীরা যখন ভয়ে কুঁকড়ে থাকত। শিবুদাই তখন সাহস দিত । বলত , কোনও অসুবিধা হলেই আমাকে জানাবি । মীরার মনে হত , এই পৃথিবীতে একটা মানুষ অন্তত আছে , যে তার কথা ভাবে । একদিন সেই শিবুদাও তার পাহারাদারির মাশুল চাইল । সেদিন অবশ্য মীরা নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল। ভক্ত যেভাবে ভগবানের কাছে নিজের সবটুকু দেয় সেইভাবে । মীরার শরীরটা যে খুব দামী শিবুদাই তাকে বুঝিয়েছিল ।
মেয়ের মানসিক কষ্টের খোঁজ না নিলেও মেয়ের আনন্দের কারণ জানতে মিঃ ব্যানার্জীর সময় লাগেনি । চটপট হাওড়ার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল তাকে। শুরু হয়েছিল মীরার জন্য পাত্র দেখা । সেই সময় মীরার বয়স তেইশ । নীরুর কুড়ি । সবচেয়ে মজার ব্যাপার যারাই মীরাকে দেখতে আসত তাদেরই নীরুকে পছন্দ হয়ে যেত। পাত্রপক্ষ মীরার সামনেই বলত ,” আপনার ছোট মেয়েটাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে । আপনারা যদি রাজি থাকেন …।“
প্রথমবার এমন প্রস্তাবে মীরার খুব অপমান বোধ হয়েছিল । বুকের ভেতর এক দম চাপা কষ্ট । যে কষ্টের কথা কাউকে বলা যায় না । লোকে শুনলে হয়ত বলবে, ভীষণ হিংসুক মেয়ে । ছোট বোনকে হিংসা করে । কিন্তু এ যে কত বড় অপমান সেই বুঝতে পারবে যে এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছে ।
এই অপমান জিনিসটাও বড় অদ্ভুত । একইভাবে বারবার অপমানিত হলে সেটাও কেমন যেন গা সওয়া হয়ে যায় । মনে হয় , আমি এই রকমই ব্যবহারের যোগ্য । সেই গল্পটার মত। যেখানে একটা গাছের কাছে এসে প্রতিদিন এসে গ্রামের লোক গালাগালি দিত , গালাগালি শুনতে শুনতে গাছটা কেমন যেন নির্জীব হয়ে যাচ্ছিল । তারপর একদিন গ্রামের লোক দেখল , গাছটা আপনা আপনিই মরে গেছে । মীরারও তেমনি একটু একটু করে নির্জীব হয়ে পড়ছিল। মীরাকে দেখতে এলে নীরুও সাজত । নানা অছিলায় পাত্রপক্ষের সামনে যেত। অথচ এমন একটা ভাব দেখাত যেন অজান্তেই পাত্রপক্ষের সামনে এসে পড়েছে ।
কিছুদিন হাওড়ায় থাকার পর মীরাকে আবার গ্রামে ফিরে আসতে হল। বাবার রান্না খাওয়ার খুব অসুবিধা হচ্ছিল যে । গ্রামে ফিরে আসতে পেরে মীরা খুশি হয়েছিল । এখানে আর কিছু না হোক তার কাজের কদর আছে ।
একদিন হাওড়া থেকে এসে বাবা আমতা আমতা করে বলল, “নীরুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল রে । ওরা এত তাড়াহুড়ো করল … আর তোর মাও এত ভাল একটা সম্বন্ধ … আসলে অনেক বাড়িতেই এমন হয় বুঝলি … ছোটটার আগে বিয়ে …”
বাবার এই চোখ নামিয়ে কথা বলা , একটা বাক্যও শেষ না করা , মীরাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না । মীরা বাবার পায়ের কাছে বসে মাথা নিচু করে বসেছিল । একসময় বাবা মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল ,” সবার ভাগ্য এক হয় না রে মা । কিছু মানুষের জীবনে অনেক লড়াই থাকে । “
শিবুদা ভর দুপুরে মীরার কাছে আসত । একদিন মীরা বলেছিল , “আমায় বিয়ে করবে শিবু দা ?”
প্রশ্নটা শুনে , চমকে উঠেছিল শিবু । তার কিছুদিন পরেই মীরা জানতে পারল শিবুর বিয়ের কথা ।
(চার)
একের পর এক আঘাত খেতে খেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছিল মীরার । শিবুর বিয়ে ছিল মীরার জীবনে শেষ আঘাত । এরপরই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সে । না ঘুরে যে উপায় ছিল না । তখন মীরা মরিয়া হয়ে একটা অবলম্বন খুঁজছিল । বাঁচতে হবে , যেভাবেই হোক বাঁচতে হবে ।
মীরার শরীরে যৌবন যেতে যেতেও যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেছে । এখানকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ পেয়েছে সে। বেশি বেতন নয় , তবে চাকরিটা তাকে স্বাধীনতা দিয়েছে । এই থমকে যাওয়া যৌবনকে মীরা এখন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে । বাবা মারা যাওয়ার পর একাই থাকে সে। মীরা এখন নিজেকে সাজাতে জানে । জানে ক্যামেরার কোন অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করলে লাইক -কমেন্টের বন্যা বয়ে যাবে । তার একা থাকা নিয়ে পাড়ায় ঝড় উঠেছিল। এখন সে আর ঝড়ে নুয়ে পড়ে না। সে জানে তাকে ওরা ভয় পায়। কেউ কেউ ঠারেঠোরে ওকে কথা শোনায় । বলে,”বয়স তো কম হল না, এখনো এত সাজের বাহার কেন ?”
প্রথম প্রথম কষ্ট পেত । ভাবত এই সমাজে একলা একটা মেয়ের স্বাধীনভাবে নিজেকে সাজানোর অধিকারও নেই ! এখন পাড়ার লোকের কথায় মজা পায় । নিজেকে আরও স্মার্ট আরও সুন্দর করে সাজায়। সবসময় হাসিখুশি থাকে। তার জীবনে যে কোনও অপূর্ণতা আছে সে কথা ভাবতেই চায় না।
একদিন অরু আর মা এসে খুব হম্বিতম্বী করল। বলল,” তোর আর এখানে একা থাকতে হবে না। ওই কটা মায়নার চাকরি করার দরকার নেই। আমাদের সঙ্গে হাওড়ায় চল। তুই এখানে যা টাকা পাস তার থেকে তো বেশি অরু ওর বাড়ির কাজের মেয়েকে দেয়। ওখানে নিজের বাড়ির কাজ করবি। এখানে রুগীর গু মুত কাঁচানোর থেকে সেটা অনেক সম্মানের । “
মীরা খুব শীতল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিল, “আমি কোথাও যাব না।“
অরু দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল তা যাবি কেন ? “এখানে থাকলে তো নচ্ছারগিরি করতে পারবি।“
পাঁচ বছরের ছোট ভাইয়ের মুখের ভাষায় কেঁপে উঠেছিল মীরা । মনে হয়েছিল মেয়েরা এত অসহায় কেন? কত সহজ একটা মেয়ের চরিত্রে কালি ছড়ানো যায়। মা আর অরুর রাগের কারণ মীরা জানে। বাবা মৃত্যুর আগে এই ছোট্ট একচিলতে ঘরটা তার নামে কিনে দিয়েছেন। একটা মেয়ে নিজের ঘরে নিজস্ব উপার্জনে মাথা উঁচু করে থাকবে, সমাজ তো দূর অস্ত, নিজের মা ভাইও মেনে নিতে পারে না।
মা আর অরুকে ফিরিয়ে দিয়ে মীরার একটু যে ভয় ভয় করেনি তা নয়। বারবার মনে হচ্ছিল, সমাজ সংসারের বিরুদ্ধে গিয়ে সে যা করতে চাইছে তাতে সফল হবে তো?
মীরা ‘অ্যাম্বারগ্রিসের’ কথা জানে। এ এক অদ্ভুত জিনিস। এর এক এক আউন্স বিক্রি হয় কয়েক স্বর্ণমুদ্রায়। কেউ কি কল্পনা করতে পারে , অভিজাত নারী পুরুষ যে সুগন্ধি মেখে তৃপ্ত হয় সেটা পাওয়া যায় রুগ্ন তিমির বদহজমের থেকে।
মীরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করতে করতে খুঁজে বেড়ায় সংসারের সেইসব অবাঞ্ছিত সন্তানদের। রুগ্ন তিমির মতই যাদের রূপ নেই, কিন্তু বুকের ভেতর আছে বহু মুল্যবান সুগন্ধি। একটু স্নেহের স্পর্শ পেলে তারাও হয়ত হয়ে উঠবে এক একটি অ্যাম্বারগ্রিস। এই পুঁতিগন্ধময় সমাজে আলো আর সুগন্ধ ছড়াবে … মীরা খুঁজতে থাকে