ছেলেবেলায় পুজোয় হয়ে উঠতাম শঙ্কর, খুঁজতাম চাঁদের পাহাড়: ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী
Celebrity Durga Puja: এখন পুজো ঠিক কেমন পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর কাছে? ছোটবেলার পুজোই বা তাঁর কাছে ঠিক কেমন ছিল? অথবা পুজো এলে কোন বিষয়টি সবথেকে বেশি মনে পড়ে তাঁর? শোনামাত্রই ভিড়, হইচই, মানুষের চেঁচামেচি, উল্লাসকে পিছনে ফেলে প্রায় পাঁচ দশক আগের সময়ে ডুব দিলেন তিনি। সাক্ষী থাকল আজকাল ডট ইন।
রাহুল মজুমদার
এখন পুজো ঠিক কেমন পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর কাছে? ছোটবেলার পুজোই বা তাঁর কাছে ঠিক কেমন ছিল? অথবা পুজো এলে কোন বিষয়টি সবথেকে বেশি মনে পড়ে তাঁর? শোনামাত্রই ভিড়, হইচই, মানুষের চেঁচামেচি, উল্লাসকে পিছনে ফেলে প্রায় পাঁচ দশক আগের সময়ে ডুব দিলেন তিনি। সাক্ষী থাকল আজকাল ডট ইন।
"আমি কিন্তু কলকাতায় নয়, চুঁচুড়াতে বড় হয়েছি। সেটা সাতের দশক। স্বভাবতই আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময় মফস্সলে দুর্গাপুজোর এত আড়ম্বর থাকত না। পাড়ায় পাড়ায় পুজো হত। সেটার উত্তেজনা বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের যৌথ পরিবার ছিল, খুব জমজমাট। মনে আছে, আমাদের বাড়িতে মহালয়ার দিন একটা পুজো হত। কী পুজো, সেসব বিশদে আর মনে নেই এখন। তবে এটা বেশ মনে আছে, আলো ফোটার আগেই উঠে পড়তাম। আমার ছোটকাকা সেকালের ঢাউস রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া চালিয়ে দিতেন, যা কোনওদিনই প্রথম থেকে শুনতে পারিনি। আধো ঘুমে থাকতাম। তারপর কোনওরকমে স্নান-টান সেরে আনকোরা নতুন জামা পরে পুজোতে বসতাম বাড়ির বাকিদের সঙ্গে। খুব হইচই হত। তারপর খাওয়াদাওয়া।
পুজোর আসল মজা ছিল ওই দিনগুলোয় কেউ আমাকে পড়তে বসতে বলবে না। ওইটাই ছিল আমার কাছে পুজোর আসল মজা। ঘুম থেকে উঠেই হাত-মুখ ধুয়ে পাড়ায় বেরিয়ে পড়তাম। স্রেফ এদিক-ওদিক ঘুরব। পুজোর সময়ে যৌথ পরিবারে থাকার একটা মজা হল, বাবা-মায়ের অত সময় থাকে না সন্তানের উপর 'হেলিকপ্টারিং' করার। তাঁরাও তো বাড়ির পুজোর নানান ঝামেলায় ব্যস্ত! আর পাড়ায় তখন যে যার বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারত। খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। ছোটরা তো ঢুকে পড়তই। তখন আসলে 'প্রাইভেসি' বলে কোনও ভাবনা ছিল না কারও মনেই। আর ছিল নতুন বন্ধু হওয়া। মানে ধরুন, আমাদের পাড়ায় কারও বাড়িতে তাঁদের আত্মীয়েরা ঘুরতে এলেন এবং সেই পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য আছে আমাদের বয়সি... ব্যস! বন্ধু হয়ে গেল। আর সে কী বন্ধুত্ব, হইচই... মনে হত সেটাই বুঝি পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর বন্ধুত্ব। আজকাল তো আর সেসব ভাবাই যায় না..." বলতে বলতে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে 'ছোটলোক' ওয়েব-সিরিজের পরিচালকের।
সামান্য থেমে ইন্দ্রনীল ফের বলে ওঠেন, "আমাদের কাছে সেই সময়ে একটা করে টিনের বন্দুক থাকত। স্টিল রং করা। পকেটভরা ক্যাপ থাকত। সেইসব বন্দুকে ভরে ফটাস-ফটাস করে ফাটাতাম। থাকত সিঙ্গল শটের টিপ-ক্যাপও। আর জানেন, পুজোর সকাল-দুপুরগুলো ছিল অনেক বেশি অভিযানের মতো । পাড়ার সব বন্ধুরা একত্রিত হতাম পাড়ার প্যান্ডেলে। সঙ্গে থাকত আমাদের বয়সি সেইসব ছেলেমেয়েরা, যারা আমাদের পাড়ায় ঘুরতে এসেছে। তারপর সবাই মিলে হল্লা পাকিয়ে এপাড়া-ওপাড়ার নতুন অলিগলি খুঁজে বেড়ানো। আমাদের সেইসব বন্ধুদের মধ্যে তখন কারও বাবা হয়তো রিকশা চালান, কারও মা হয়তো অন্যদের বাড়ির বাসন মাজেন... কিন্তু ছোটদের মধ্যে কবেই-বা এই শ্রেণির জটিল হিসাব অথবা অঙ্কের বিদ্যা থাকে? আমাদের মধ্যেও ছিল না। খুব স্বাভাবিক ছিল সেসব। কেউ কিছু এসব বলতেন না, বোঝাতেন না। এবং কারও ইচ্ছেও ছিল না। আর এই যে নানাবিধ বাচ্চাদের যে-সমাগম হত, তাদের মধ্যে একজন হত দলনেতা। তারপরেই আসল মজা শুরু। সেই দলনেতা তার সৈনিকদের কোনও চেনা বাড়িতে নিয়ে গেল। সবাই মিলে সেখানে গেলামও। গিয়ে চারটে নাড়ু, দুটো লুচি আর মিষ্টিও হয়তো পেয়ে গেলাম। তারপর সবার সঙ্গে ভাগ করে খাওয়া। একটা হুল্লোড়ে, লাগামছাড়া ব্যাপার হত আর কি!"
প্রশ্ন ছিল, এই যে অচেনা পাড়ার গলিতে ঘুরতে যেত ছোট ছেলেমেয়েরা, তখন ছেলেধরার ভয় ছিল না? স্মিত হেসে 'মায়ার জঞ্জাল' ছবির পরিচালকের উত্তর ভেসে আসে, "না, না, ছিল। আমাদের ভয় দেখানো হত। কিন্তু আমরা যে খুব দূরে চলে যেতাম এমনটা নয়। তখন পাশাপাশি পাঁচ-ছ'টা পাড়ার লোকজন পরস্পরকে চিনতেন। আর আমাদের দলের বন্ধুগুলোও তো এই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার পাড়ার থেকেই আসত। ফলে ওই সাহসের জায়গাটাও থাকত। তাছাড়া একটা পাড়া শেষ হচ্ছে কখন আর তারপর আরও একটা পাড়ায় ঢুকে পড়ছি এ-গলি, ও-গলি দিয়ে... হয়তো একটা গলি দূর থেকে দেখেছি, এবার সেই গলিতে ঢুকে একটা বাঁক নিতেই দেখলাম সামনেই একটা বিরাট পুকুর! এই যে নতুন দেশ আবিষ্কার করার মতো ব্যাপার, এটা যে কী অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার ছিল! নিজেকে 'চাঁদের পাহাড়'-এর শঙ্কর মনে হত। তাই পুজো ছিল আমাদের কাছে আবিষ্কারও।"
আর খাওয়া? "পুজোর সময়ে আমাদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া চলতেই থাকত। কখন হুট করে অতিথি চলে আসছেন, আবার বাড়ির পুরুষ-সদস্যরাও ছুটির মেজাজে। হয়তো তাস খেলতে বসে পড়েছে পাড়ায়, হয়ে গেল! কখন কে খেতে চাইবে তার কোনও ঠিক ছিল না। আর ঝামেলা পোহাতে হত আমার মা'কে। খুব বিরক্ত হতেন তিনি এবং এখন মনে হয় প্রচণ্ড বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। নাওয়া-খাওয়ার কোনও ঠিক থাকত না মায়ের। 'ক্যায়োটিক ইয়েট বিউটিফুল' প্রবাদটি অর্ধেক আমার জন্য ছিল আর অর্ধেক মায়ের জন্য। মানে, পুজোর ওই সময়টা আমার জন্য 'বিউটিফুল' ছিল অথচ মায়ের জন্য 'ক্যায়োটিক'। খুব ঝামেলার, খুব কষ্টকর! স্কুলেও পড়াতেন আবার বাড়ির সমস্ত কাজকর্মও তাঁকে করতে হত। আর জানেন তো, বয়স্ক লোকেরাও তখন পুজোর সময় কীভাবে অবসর কাটাবেন তা নিয়ে ভাবতেন না। নাতি-নাতনিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
আর ভাসান? তখনও কি দুর্গা পুজোর ভাসান মানেই চরম বিশৃঙ্খলা, ঝামেলা? জবাব এল, "অনেক, অনেক কম। নেশা করে তেমন কেউ প্রকাশ্যে অসভ্যতামি করত না। মানুষ অকারণে রে-রে করে উঠত না। শান্ত থাকত।" ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে সম্মানিত এই পরিচালককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সুযোগ পেলে সেই সময়ের পুজোর কোন একটি বিষয় তিনি এই সময়ের পুজোতে ফিরিয়ে আনবেন? সামান্য থেমে অস্ফুটে বলে ওঠেন, "যৌথতা। বর্তমানে যৌথতা তো সমাজ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। আজকাল মানুষ দেখায় পুজোয় তারা কে কত বেশি আনন্দ করতে পারে। এবং তা সবাইকে দেখতে পারে। তখন আনন্দ দেখাতে হত না, এমনিই হত। মানুষ তো এখন বড্ড একা হয়ে গিয়েছে। আর একা হয়ে গেলে বেশি করে আনন্দ করছি, তা দেখানোর প্রয়োজন পড়ে। তাই না?"