মহারাজা নরনারায়ণ ভূপ বাহাদুরের স্বপ্নে পাওয়া বড়দেবীর পুজো হয় আজও রাজাচার মেনেই, প্রথম মুখ দেখেন জেলাশাসক ও রাজ প্রতিনিধি 'দুয়ারবক্সি'

দ্বিতীয়ার সকালে ' দেও দেখা ' - র মধ্যে দিয়ে কোচবিহারের মহারাজাদের ৫০০ বছর অতিক্রান্ত বড় দেবীর পুজো শুরু হয়েছে রাজপ্রথা মেনেই। বিশালায়ত খোশাতে প্রথম মুখ দেখেন জেলা শাসক ও রাজ প্রতিনিধি 'দুয়ারবক্সি' ।

History of Durgapuja in coochbehar
বড় দেবী

দিব্যেন্দু ভৌমিক

দ্বিতীয়ার সকালে 'দেও দেখা' - র মধ্যে দিয়ে কোচবিহারের মহারাজাদের ৫০০ বছর অতিক্রান্ত বড় দেবীর পুজো শুরু হয়েছে রাজপ্রথা মেনেই। বিশালায়ত খোশাতে প্রথম মুখ দেখেন জেলা শাসক ও রাজ প্রতিনিধি 'দুয়ারবক্সি'।

               

শুক্রবার সকাল ঘড়ির কাঁটায় তখন ৮ টা বেজে ২০ মিনিট। অঞ্জলি শেষে রাজ আমলের বিশালায়ত কোশাকুশিতে মায়ের মুখ ভেসে উঠল! প্রথমে মায়ের মুখ দেখলেন কোচবিহার দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি তথা জেলাশাসক অরবিন্দ কুমার মিনা। সঙ্গে রাজপ্রতিনিধি তথা 'দুয়ারবক্সি' অজয় কুমার দেববক্সি।পুরোহিত দীনেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য -এর কণ্ঠে উচ্চারিত হল বৈদিক মন্ত্র। ধ্বনিত হয় উলু। বেজে উঠল শাঁখ। আর সেই সঙ্গে দ্বিতীয়ার সকালে 'দেও দেখা' বা মায়ের মুখ দর্শনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে গেল কোচবিহারের মহারাজাদের ৫০০ বছরের পুরনো বড়দেবীর পুজো।  

       

       

যথাবিহিত রাজ আমলে রীতি মেনেই বাকি দিনগুলোতে হবে পুজোর আচার।  মহারাজা নর নারায়ণের স্বপ্নাদেশে প্রাপ্ত মূর্তিই এই বড়দেবী। ময়না কাঠের কাঠামোতে নির্মিত একটু ভিন্ন অবয়ব,  ভিন্নসাজে,  আলাদা ধাঁচে, পৃথক নিয়ম রীতিতে বড়দেবীর পূজা সমাপন হয়। মা রক্তবর্ণ। অসুর সবুজ।  মায়ের সঙ্গে নেই সন্তানরা, আছে দুই সখী -জয়া ও বিজয়া। মায়ের বাহন বাঘ ও সিংহ। 'রাজ উপাখ্যান'- এ এখানে নরবলির উল্লেখ আছে।  তবে এখন মহাষ্টমীর দুপুরে হয় মোষ বলি। অষ্টমীর গভীর নিশীথে আজও কয়েক ফোটা রক্ত ব্যবহৃত হয় 'গুপ্ত পুজোয়'। 

                   

৫০০  বছরেরও বেশি সময়ের আগে অসমের চিকনা পাহাড়ের একটি ঘটনা বা জনশ্রুতি বড় দেবীর মন্দিরে প্রতিভাত হয়ে আসছে বছরের পর বছর। সেদিন নিছকই খেলার চলে দেবীর পুজো করছিল দুই ভাই চন্দন ও বিশু। সঙ্গী ছিল শিশু,  বাঘা, টেংগনা, গলা, পানবর। ময়না কাঠ  মাটিতে পুঁতে তার উপর ফুল ছড়িয়ে শুরু হয় 'মা ভগবতী' জ্ঞানে পুজো চলে। কেউ গাইছিল, কেউ নাচছিল। হঠাৎ মনে হল, পুজো হল, কিন্তু দেবীকে তুষ্ট করতে তো বলি দেওয়া হল না!  অমনি তারা ঠিক করল 'বলি' দিতেই হবে।  কিন্তু কাকেই বা দেওয়া হবে!  ঠিক হল খেলার ছলে নরবলি দেওয়া হবে এবং তার খেলার সাথীদের মধ্যে সব থেকে ছোট তাকেই বলি দেওয়া হবে।  সেইমতো এক বালককে 'বলি' কল্পনা করে তাকে পাঠার মতো করে ধরে কেন্দু পাতায় নির্মিত 'নকল খরগো' দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করা হল। চারিদিকে ধ্বনিত হল -'ভগবতী বলিং গ্রিন্য।' সেদিনের অসমের চিকনা পাহাড়ের সেই ৯ বছরের বালকই পরবর্তীকালে কোচবিহার রাজ্যের প্রথম রাজা 'বিশ্বসিংহ'। এভাবেই খেলার ছলে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিক সূচনা কোচরাজ্যে।

                 

ইতিহাসবিদ ড: নৃপেন্দ্রনাথপালের অভিমত,  'কোচবিহার রাজারা ছিলেন শিবভক্ত। কিন্তু পরবর্তীকালে মহারাজা নরনারায়ণ স্বপ্নাদেশ পাওয়ায় দেবীর আরাধনা শুরু করেন। আর সেই দেবীই বড়দেবী। 'কোচবিহারের মানুষের আবেগ বড়দিনকে ঘিরে। পুজোর কটা দিন জেলার মানুষের প্রথম ও প্রধান গন্তব্য বড়দেবী মন্দির প্রাঙ্গণ। কোচবিহার দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ড পরিচালিত এই মন্দির ও পুজো। কোচবিহারের জেলা শাসক ও ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি অরবিন্দ কুমার মিনা পুজো শেষে বলেন, 'রাজ ঐতিহ্যবাহী বড় দেবীর পুজোতে অংশ নিতে পেরে জেলাশাসক হিসেবে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে হয়। এখানে অনুভূতিটাই আলাদা। আজ বড় দেবীর পুজো শুরু হয়ে গেল। সমস্ত কোচবিহারবাসীকে জানাই দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা।'