রাজবাড়ির পুজোতে হয় না শঙ্খধ্বনি, রাজমহিষীরা পুজোয় যোগ দিতেন গুপ্ত পাতালপথে
বর্ধমান তো বটেই, গোটা রাজ্যের অন্যতম পুরনো দুর্গোৎসব বর্ধমান রাজবাড়ির 'পটেশ্বরী'র পুজো।

আজকাল ওয়েবডেস্ক: বর্ধমান তো বটেই, গোটা রাজ্যের অন্যতম পুরনো দুর্গোৎসব বর্ধমান রাজবাড়ির 'পটেশ্বরী'র পুজো। সাড়ে তিনশো বছর। ইতিহাসের এক দীর্ঘ পরিক্রমা। বর্ধমানের রাজাদের অন্যতম আরাধ্য লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরে ধুমধাম করে পুজো হত একসময়। তার আগে হত মহতাব মঞ্জিল অর্থাৎ রাজবাড়ির লাগোয়া মন্দিরে।
একবার নয়, বছরে দু'বার এখান দুর্গাপুজো হয়। একবার চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজো। অন্যটি এই শারদোৎসব । রাজবাড়ির অন্ত:পুর থেকে রাজমহিষিরা আসতেন এই মন্দিরে। হত নানা অনুষ্ঠান। মন্দিরের দালানের উপরে দর্শনী দিয়ে তাঁরা অনুষ্ঠান দেখতেন। প্রজারা তাঁদের মুখ দেখতে পেতেন না। তাঁরা জানতেন রাজমহিষীরা পুজো দেখছেন কিন্তু কীভাবে সেটা প্রজাদের নজরে পড়ত না। কথিত আছে,গুপ্ত পাতালপথে রাজমহিষীরা রাজবাড়ী থেকে এখানে আসা যাওয়া করতেন।
বর্ধমান রাজবাড়ির কুলদেবী চন্ডী। তিনিও এখানে অধিষ্ঠাত্রী। যদিও রাজ পরিবারের সদস্যরা ছাড়া তাঁর মুখ অন্য কেউ দেখতে পান না। এই মন্দিরে চন্ডী ছাড়াও আছেন শিলামূর্তিতে লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ। আছেন রামচন্দ্র। আছেন পাতালেশ্বর শিব। গণেশ এবং অন্যান্য আরও অনেক মূর্তি। এখনো প্রতিদিন খাস আতপ চালের ভোগ নিবেদন করা হয় । রাতে লুচি আর মিষ্টি দিয়ে দেবতাকে দেওয়া হয় শীতল ভোগ। এখানে শারদোৎসব ছাড়াও ধুমধামে পালিত হত রথ। রথ এখানে দুটি। একটি পিতলের এবং অন্যটি কাঠের। এখানে একসময় সারম্বরে পালিত হত ঝুলনযাত্রা। পালিত হত জন্মাষ্টমী। এখনও হয়। রথে মেলাও বসে। কিন্তু সে জৌলুস আর নেই। সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে আগেকার সেই চাকচিক্য।
জমিদারি প্রথা বিলোপের পর বর্ধমান রাজাদের সেই বৈভব আর নেই। যদিও এখনও রাজ পরিবারের অনুগ্রহেই ব্যয় নির্বাহ হয় এই মন্দিরের। ১৯৫২ সালে কমিউনিস্ট নেতা বিনয় চৌধুরীর কাছে ভোটে হেরে অভিমানে বর্ধমান ত্যাগ করেন রাজা উদয়চাঁদ মহতাব। যদিও তাঁর পুত্র প্রণয়চাঁদ মহতাব শেষদিন পর্যন্ত এই পুজোর ব্যয় চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পর এখন দায়িত্বে রাজমহিষী নন্দিনী মহতাব। আগের মতো সেই জৌলুস না থাকলেও নিষ্ঠার সঙ্গে এখনও পটেশ্বরীর পুজো হয়। পটেশ্বরীর পুজো হয় কিন্তু বছরে দু'বার। চৈত্রের মতো শরতের প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত এখানে পুজো হয়।
পটেশ্বরী মাটির মূর্তি নন। পটে আঁকা। শিল্পীর হাতে পটে আঁকা দশভূজা মূর্তি। অনুপম তাঁর রূপ। এখানে প্রতিপদে ঘট স্থাপন হয়। প্রতিদিন ভোগে থাকে হালুয়া,ছোলা এবং পুরী।বর্ধমান মহিলা কলেজ ছিল রাজবাড়ীর অংশ। সেখানেই তাঁর পুজো হত। ১৯৮৪ সালের পর সেই মন্দির না থাকায় এই মন্দিরে নিয়ে আসা হয় তাঁকে। পুজো হত পাটশালায়। এখন হয় মন্দিরের ভিতরেই। আগে এ পুজোয় বলি হত। কিন্তু পরে সেই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
কালের নিয়মে মন্দির আজ জরাজীর্ণ। বয়সের ছাপ তার সর্বাঙ্গে। নাটমন্দির থেকে মন্দির চত্বর, সর্বত্র পলেস্তারা খসে পড়েছে। দীর্ঘদিন সংস্কার হয়নি।রাজ্যের এই প্রাচীন গৌরব রক্ষায় সরকার কিছুটা উদাসীন বলেই অনেকে অভিযোগ করেন। তবু প্রতিবছর এখানে পূজিতা হয়ে আসছেন পটেশ্বরী। পুজোর কদিন এখান গুজরাটী সম্প্রদায়ের ডান্ডিয়া নাচ হয়। পুজো দেখতে আসেন ইতিহাসের অনুরাগী অনেক মানুষ। অনেকে বলেন এই দালানে এলে সাড়ে তিনশো বছরের ইতিহাস যেন সামনে এসে দাঁড়ায়। ফিসফিস করে সে বলে তার অতীতের গৌরবগাথা। বাংলার জীবনের অমিত ঐশ্বর্য তার হারিয়ে যাওয়া রূপ মেলে ধরতে চায়। আগে পটেশ্বরীর বিসর্জন হত। এখন আর হয় না।
রাজ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উত্তম মিশ্র জানান, মন্দিরের অবস্থা ভগ্নপ্রায়। মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদ গত হয়েছেন। কোনোক্রমে বছরে দু'বার পুজো চলে আসছে। সেই জাঁকজমক নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে ভক্তি। ইতিহাস গবেষক শ্যামসুন্দর বেরা জানান, 'বর্ধমানের রাজবাড়ি কয়েকবার স্থান বদলেছে। কাঞ্চননগরে পটেশ্বরীর পুজো শুরু হয়। পরে মহতাব মঞ্জিলে( রাজবাড়ী) তাঁর পুজো হত। সেই মন্দির না থাকায় পুজো হয় লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরে। তিনি জানান, বর্ধমানের রাজ পরিবার আদিতে পাঞ্জাব থেকে এসেছিলেন। এই পুজোয় সেই রীতির কিছু প্রভাব রয়েছে। এই পুজোয় কোনও শঙ্খধ্বনি হয় না।'