ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই জমিদারবাড়ির নাম, তবু পুজো এলেই বাড়ির মহিলাদের ঠেলে দেওয়া হয় অনেকদূরে
Durga Pujo 2025: বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাহচর্য্য পাওয়া এই জমিদারবাড়ির মহিলারা দুর্গা পুজোয় পর্দানশীন থাকেন। পুজোর জোগাড়েও নিষিদ্ধ থাকেন তাঁরা। নারীর মুক্তি ও নারীর প্রগতি প্রতিষ্ঠায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আজও স্মরণ করে গোটা বাংলা। কিন্তু তারই মধ্যে ব্যতিক্রম যেন পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের চকদিঘির সিংহরায় জমিদারবাড়ি।

আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাহচর্য্য পাওয়া এই জমিদারবাড়ির মহিলারা দুর্গা পুজোয় পর্দানশীন থাকেন। পুজোর জোগাড়েও নিষিদ্ধ থাকেন তাঁরা।
নারীর মুক্তি ও নারীর প্রগতি প্রতিষ্ঠায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আজও স্মরণ করে গোটা বাংলা। কিন্তু তারই মধ্যে ব্যতিক্রম যেন পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের চকদিঘির সিংহরায় জমিদারবাড়ি। বিদ্যাসাগরের সাহচর্য্য পাওয়া সত্ত্বেও এই বাড়ির মহিলাদের শুধুমাত্র আভিজাত্য বজায় রাখতে আজও দুর্গা পুজোর সময় পর্দার আড়ালেই থাকতে হয়। জমিদারি প্রথা এখন আর নেই। তবুও দুর্গা পুজোর সময় পর্দার আড়ালে থাকাটাকেই ভবিতব্য মেনে নিয়ে চলতে হচ্ছে চকদিঘির জমিদার বাড়ির মহিলাদের ।
ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব কালে এই বাংলায় জমিদারি ব্যবস্থার পত্তন হয়। সেই সমসাময়িক কালের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জামালপুরের চকদিঘির জমিদারদের নাম। দেশ স্বাধীন হবার পর জমিদারি প্রথা বিলীন হয়ে গেলেও ৩৭৫ বছরেও বেশী সময়কাল ধরে চকদিঘির বাগানবাটি সেই জমিদারি ঐতিহ্যেরই স্বাক্ষ্য বহন করছে ।একশো বিঘা জমি জুড়ে রয়েছে জমিদারদের বাগানবাটি । যার কোনায় কোনায় ছড়িয়ে রয়েছে জমিদারি রাজত্বের নানা নিদর্শন। ঐতিহ্য পরম্পরা মেনে এই বাগানবাটির সুবিশাল মন্দিরে তিন শতাধিক বছর ধরে পুজিত হয়ে আসছেন দেবী দুর্গা। একদা পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দুর্গা পুজোয় এই বাগানবাটিতে এসে থাকতেন। কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর একটি সিনেমার শুটিংয়ের জন্য এই বাগানবাটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। জমিদারি রাজত্ব আজ আর নেই। তবে জমিদারি আভিজাত্যের গড়িমায় খামতি টানতে চাননি চকদিঘির জমিদার সারদপ্রসাদ সিংহ রায়ের উত্তরসূরীরা ।
কথিত আছে, চকদিঘির জমিদারদের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন রাজপুত ক্ষত্রিয়। ইতিহাস প্রসিদ্ধ বুন্দেলখণ্ডের শাসকদের বংশধররা চকদিঘিতে জমিদারি চালাতেন। দুর্গাচরণ রায় লিখিত 'দেবগণের মর্ত্যে আগমন' নামক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে চকদিঘির জমিদারদের কথা। তার থেকে জানা যায় ,রাজস্থান থেকে চকদিঘিতে সর্বপ্রথম এসে ছাউনি ফেলেছিলেন নল সিং । সেখানেই তিনি বসবাস শুরু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে জমিদারিত্ব লাভের পর নল সিং অগাধ ঐশ্বর্য্য ও খ্যাতি লাভে সমর্থ হন। তিনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের থেকে এই জমিদারি লাভ করেন। দামোদরের পূর্ব তীরের ’শুড়া’ মৌজাস্থিত হাজামজা জলাশয় ও দিঘি সমেত নিস্কর জমিদারি স্থানটি পরবর্তিকালে পরিচিতি পায় চকদিঘি নামে ।
জামালপুরের চকদিঘির সিংহ রায় জমিদারবাড়ির বাগানবাটির ভিতর কাছাড়িবাড়ির সামনেই রয়েছে দুর্গা পুজোর স্থায়ী মন্দির। মন্দিরের সঙ্গেই রয়েছে টিনের ছাউনি দেওয়া বিশাল আকারের বসার জায়গা। জমিদারবাড়ির বর্তমান কেয়ারটেকার পীযুষ বিদ জানিয়েছেন,’এই জমিদার পরিবারের অপর দুর্গা মন্দিরটি আছে চকদিঘি থেকে প্রায় তিন কিমি দূরে মণিরামবাটি গ্রামে। সেখানকার মন্দিরটিও একই আদলে তৈরি। সেখানেও জমিদারি ঐতিহ্য মেনে দুর্গা পুজোর যাবতীয় আয়োজন করা হয়। পঞ্জিকার সময় সারণী মেনে একই সময়ে দুই বাড়ির মন্দিরে হয় পুজো। ব্যবসা ও কর্মসূত্রে সিংহ রায় পরিবারের বর্তমান সদস্যরা বছরের বাকি দিনগুলিতে কলকাতা ও অন্যত্র কাটান ঠিকই। তবে পুজোর ক'টাদিন গোটা পরিবার একত্রিত হন চকদিঘির বাগানবাটিতে ।
বৈদিক মতে সিংহ রায় জমিদার বড়ির দুর্গা পুজোর আরাধনা হয়। একচালার কাঠামোয় ডাকের সাজে প্রতিমা সাজানো হয়। দেবী মূর্তির দু’পাশে বসানো থাকে জয়া ও বিজয়া নামে দুই পরীর মূর্তি। মন্দির চত্ত্বর সাজানো হয় এক ভিন্ন আঙ্গিকে। একটি গোটা নারকেল , আম্র পল্লব ও একটি কাঁঠালি কলা একসঙ্গে নিয়ে বাঁধা থাকে মন্দির চত্ত্বরের প্রতিটি থামে। প্রতিপদের দিন থেকে শুরু হয় পুজো। পঞ্জিকার নির্ঘন্ট মেনে পুজো করেন হুগলীর লোকনাথ এলাকার কুল পুরোহিত। পুজোয় অন্যন্য ফল যাই থাক কাজু , কিসমিস , পেস্তা ,আখরোট ও মেওয়া ফল চাই। নৈবেদ্য সাজানো হয় চিনির সন্দেশ , ছোট ও বড় মুণ্ডি , ডোনা , নবাত , রশকরা, মুড়কি প্রভৃতি দিয়ে । পারিবারিক নিয়ম মেনে স্থলপদ্মে হয় দেবীর পুজো। একমাত্র সন্ধি পুজোয় লাগে ১০৮টি জল পদ্ম । সন্ধি পুজোর সময় দু'টি মন্দিরের দেবী প্রতিমার সামনে ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবা মহিলাকে দিয়ে ধুনো পোড়ানো হয় । পুজোর প্রতিটি দিন দেবীর কাছে নিবেদন করা হয় হরেকরকম নিরামিষ ভোগ। মহাষ্টমীর দিন থেকে পুজোর নৈবেদ্যে দেওয়া হয় ’মাখা’ সন্দেশ। আগে ছাগ বলিদান প্রথা থাকলেও বেশ কয়েক বছর হল বলিদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । পরিবর্তে এখন সন্দেশ নিবেদন করা হয়। নবমীর দিন একই সময়ে চকদিঘি ও মণিরামবাটির মন্দিরে কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। জমিদারবাড়ির পুজোর জোগাড়ে মহিলাদের অংশগ্রহন নিষিদ্ধ । সবকিছুই করেন জমিদার বংশের পুরুষরা ।
এর কারণ প্রসঙ্গে জমিদার পরিবারের বংশধরদের বক্তব্য , 'অন্দর মহল থেকে পরিবারের মহিলারা মন্দিরে পুজো দিতে কিংবা ঠাকুর দেখতে আসার সময় তাঁদের পথের দু’পাশ আড়াল করার জন্য কাপড় দিয়ে ‘কানাত’ অর্থাৎ ’পর্দা’ টাঙানো হয়। বাড়ির বউ ও মহিলারা ওই পর্দার পেছনে থাকেন। বংশ পরম্পরয়ায় এই ঐতিহ্য মেনে আসা হচ্ছে'। জমিদারবাড়ির মেয়ে ও বউদের মুখ অন্য কেউ যাতে দেখতে না পায় তাই এই ব্যবস্থা তৈরি রাখা থাকে বলে পরিবার সদস্যদের কথায় জানা গিয়েছে। আগে পুজোর সময় বাগানবাটিতে যাত্রা পালা হত । এখন সেসব পাঠ উঠে গেছে।প্রথা মেনে একাদশীতে কাঙ্গালি বিদায় পর্ব শেষে পুজোর সমাপ্তি ঘটে।
কেয়ারটেকার পীযুষ বিদ জানান,'পুজোর ক'টাদিন বাগান বাড়িতে সর্বসাধারনের প্রবেশাধিকার থাকে। তাই ভিড় উপচে পড়ে চকদিঘীর এই বাগানবাটিতে'।