নীলকণ্ঠ পাখি, কামান না থাকলেও আজও অমলিন বহরমপুরের কুঞ্জঘাটা রাজবাড়ির পুজো মণ্ডপ

৩৫০ বছরেও বেশি পুরনো বহরমপুরের কুঞ্জঘাটা এলাকায় মহারাজা নন্দকুমারের বাড়ির দুর্গাপুজো। মহারাজার বাড়ির পুজো দেখতে আজও পুজোর দিনগুলোতে শহরবাসী ভিড় জমান সেখানে।

Durga Puja 2024 Berhampore kunjaghata Rajbari pujo rituals gnr

আজকাল ওয়েবডেস্ক: ৩৫০ বছরেও বেশি পুরনো বহরমপুরের কুঞ্জঘাটা এলাকায় মহারাজা নন্দকুমারের বাড়ির দুর্গাপুজো। মহারাজার বাড়ির পুজো দেখতে আজও পুজোর দিনগুলোতে শহরবাসী ভিড় জমান সেখানে। নবাবী আমলের সেই জাঁকজমক না থাকলেও সম্পূর্ণ প্রাচীন রীতিনীতি মেনে এখনও এখানে পুজো করে আসছেন মহারাজা নন্দকুমারের বংশধরেরা। রথের দিন সুপ্রাচীন কাঠামো পুজোর মাধ্যমে এই রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। 

মহারাজা নন্দকুমারের পরিবারের দুর্গাপুজোর শুরু হয় নন্দকুমারের পিতা পদ্মনাভ রায়ের আমলে, মুর্শিদাবাদের জেলার জরুল বারালা গ্রামে। পদ্মনাভ রায় ছিলেন মুঘল আমলে বাংলার রাজস্ব সংগ্রাহক। পরবর্তীকালে এই পুজো বর্ধমানের বাহাদুরপুর গ্রামে নিয়ে যান তিনি। এরপর মহারাজা নন্দকুমার, নবাব আলিবর্দী খাঁয়ের আমলে বহরমপুরে কুঞ্জঘাটা রাজবাড়ি তৈরি করার পর তাঁদের পারিবারিক এই দুর্গাপুজো বহরমপুরে স্থানান্তরিত হয়। সেই সময় থেকে কুঞ্জঘাটা রাজবাড়িতে বৈষ্ণব মতে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। 

ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলায় ব্রিটিশরা যখন ধীরে ধীরে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন সেই সময় মহারাজা নন্দকুমারের সাথে স্যার ওয়ারেন হেস্টিংস -এর সখ্য তৈরি হয়। যদিও ১৭৬৪ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসকে সরিয়ে মহারাজা নন্দকুমারকে বাংলার রাজস্ব সংগ্রাহক হিসাবে নিযুক্ত করার পর দু'জনের মধ্যে বন্ধুত্বের অবসান ঘটে। আর এই অপমানের বদলা নেওয়ার জন্যই ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর বন্ধু এবং তৎকালীন বিচারক এলাইজা ইম্পের সাথে ষড়যন্ত্র করে একটি জালিয়াতির মিথ্যে অভিযোগে রাজা নন্দকুমারকে ফাঁসিয়ে দেন। এরপর ১৭৭৫ সালের মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি হয়। 

মহারাজার পরিবারের সদস্যা রাজেশ্বরী রায় জানান, "মা ঠাকুমাদের কাছে শুনেছি মহারাজা নন্দকুমারের আমলে বিভিন্ন ব্রিটিশ সাহেব ও নবাবরা এই পুজোয় অতিথি হয়ে আসতেন। এমনকী সেই সময় আমাদের উঠোনে যাত্রাপালাও বসত। তবে এখন এই প্রথা না থাকলেও মায়ের পুজোর রীতিনীতিতে কোনও ঘাটতি থাকে না। পাড়া-প্রতিবেশী এবং আমাদের পরিবারের সদস্যরা সবাই এই পুজোয় অংশগ্রহণ করেন।"

তিনি আরও বলেন, "আমাদের এই পুজো যেহেতু বৈষ্ণব মতে হয়, তাই মায়ের ভোগও হয় নিরামিষ। তবে এই পুজোয় মাষকলাই বলি দেওয়ার প্রথা রয়েছে। একে বলা হয় মাসভক্ত বলি।"

 

ওই পরিবারের অপর সদস্য প্রতাপ শঙ্কর রায়ের কোথায় উঠে আসল নবাবী আমলে শুরু হওয়া এই পুজোর রীতিনীতির কিছু টুকরো ছবি। তিনি বলেন, "মহারাজা নন্দকুমারের আমলে যেভাবে একচালার প্রতিমা পুজো করা হত, এখনও আমরা সেই একই কাঠামোর উপর প্রতিমা নির্মাণ করে পুজো করে চলেছি। একসময় এই বাড়িতে কামান দেগে পুজোর সূচনা করা হত। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের একটা ছোট কামান ছিল। সপ্তমীর দিন আমাদের নিজেদেরকে নবপত্রিকা এবং ঘট ভাসাতে হত। তখন গঙ্গার ঘাট থেকে 'ফায়ারিং' করা হত। আর সন্ধি পুজোর সময় সঠিক নির্ঘণ্ট মেনে আবার 'ফায়ারিং' হত। তারপর সন্ধিপুজো শুরু করা হত।"

তিনি আরও বলেন, "আমরা শুনেছি একসময় রাজবাড়ির চিলেকোঠার ঘরে জোড়া নীলকণ্ঠ পাখি আসত। প্রাচীন রীতি মতে, এই নীলকন্ঠ পাখি দেবীর আগমনী বার্তা নিয়ে আসত। আবার বিসর্জনের দিন নীলকন্ঠ পাখিকে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া নিয়ম ছিল রাজার আমলে। মানা হত, এই নীলকন্ঠ পাখি হিমালয় গিয়ে মহাদেবকে দেবীর স্বর্গে প্রত্যাবর্তনের বার্তা দেবে।"

এই বাড়ির রীতি অনুযায়ী চতুর্দোলায় দুলিয়ে এখনও মায়ের বিসর্জন দেওয়া হয়। মহারাজের বজরায় করে দেবী প্রতিমাকে মাঝ গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে বিসর্জনের রীতি থাকলেও এখন কেবলমাত্র ১০-১২ জন বেহারার কাঁধে করে প্রতিমাকে নিরঞ্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রচুর মানুষের সমাবেশ ঘটে মাকে বরণ করার জন্য। সবশেষে গঙ্গারদিকে পিঠ করে মাকে বিসর্জন দেওয়ার রীতি পালন করা হয়। 

যদিও এখন নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে কিংবা সন্ধি পুজোর সময় কামান দাগিয়ে পুজো শুরু না হলেও, অপরিবর্তিতভাবে পুরনো রীতি মেনে আজও দশমীর দিন কুঞ্জঘাটা রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় অপরাজিতা পুজো।