আষাঢ়ে সূচনা হয় দুর্গাপুজোর, কাশিমবাজার রাজবাড়িতে প্রায় ৩০০ বছরে মাতৃআরাধনা

Cossimbazar rajbari durga puja

আজকাল ওয়েবডেস্ক: প্রায় ৩০০ বছর আগে শুরু হওয়া কাশিমবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো আজও অতীতের মতো সমান জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। রাজবাড়ির রায় পরিবারের বর্তমান বংশধরেরা পুরনো রীতি মেনে একইভাবে পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজবাড়ি  এবং সেখানে অনুষ্ঠিত দুর্গাপুজো দেখার জন্য প্রতি বছর পুজোর দিনগুলোতে  প্রচুর মানুষ রাজবাড়িতে জড়ো হন। 

রায় পরিবারের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, তাঁদের আদি বাড়ি ছিল বর্ধমান জেলার পাত্রসায়ের গ্রামে। পরে ব্যবসার কারণে এই পরিবার বাংলাদেশের পিরোজপুর জেলাতে চলে যান। অবিভক্ত ভারতে এই পরিবারে এক সময় দেশের অন্যতম সর্ববৃহৎ সিল্কের কাপড় রপ্তানিকারক ছিল। বাংলাতে বর্গী আক্রমণের সময় এই পরিবার নবাবদের শরণাপন্ন হয়। যেহেতু মুর্শিদাবাদ জেলা অবিভক্ত ভারতের পিরোজপুর জেলার খুব কাছে ছিল এবং কাশিমবাজারে একটি  বন্দর ছিল, সেই কারণে ব্যবসার সুবিধার জন্য রায় পরিবার এখানে এসে বসবাস শুরু করে।
 
প্রায় ৩০০ বছর আগে রায় পরিবারের সদস্য অযোধ্যারাম রায় নিজের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন যা আজও অবিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে। ১৭৪০ সালে রায় পরিবারের অন্যতম সদস্য দীনবন্ধু রায় কাশিমবাজার রাজবাড়ি তৈরি করার পর এই পুজোর জাঁকজমক এবং বৈভব অনেক বৃদ্ধি পায়। ১৭৬০ সালে এই পরিবারের সদস্য জগবন্ধু রায়কে 'মুর্শিদাবাদ কুঠি'র দেওয়ান হিসাবে নিযুক্ত করে ব্রিটিশরা।দেওয়ান হিসেবে জগবন্ধু রায়ের কাজকর্মে খুশি হয়ে ব্রিটিশ সরকার তাকে পূর্ববঙ্গে জমির 'সার্ভে' করার কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। এই সময় জগবন্ধু রায় বর্তমান বাংলাদেশের সরাইলে তাঁর জমিদারি পত্তন করেন। রায় পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের সদস্য আশুতোষ রায়, লর্ড লিনলিথগো-র কাছ থেকে 'রাজা' উপাধি পেয়েছিলেন এবং তখন থেকে রায় পরিবারের এই পুজো 'কাশিমবাজার রাজবাড়ির পুজো' নামে মুর্শিদাবাদ জেলায় খ্যাতি পায়। বর্তমান 'রানী' সুপ্রিয়া রায় এবং 'রাজা' প্রশান্ত রায়ের প্রচেষ্টায় স্বমহিমায় আজও টিকে আছে এই পুজো।
 
রাজ পরিবারের পুরোহিত গোপাল রায় বলেন, ‘আষাঢ় মাসে রথযাত্রার দিন কাঠামো পুজোর মাধ্যমে কাশিমবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। বংশপরম্পরায় মহুলার পাল পরিবার রাজবাড়ির প্রতিমা নির্মাণ করে আসছেন। দুর্গাপুজোর ঠিক আগে অনন্ত চতুর্দশীর দিন দেবীর গায়ে প্রথম রঙের প্রলেপ পড়ে।‘ মহালয়া অথবা তার আগের দিন প্রতিমাকে বেদিতে তোলা হয়। দেবীপক্ষের শুক্লা প্রতিপদ থেকে শুরু হয়ে যায় রাজ পরিবারের দুর্গাপুজো। 


গোপাল রায় বলেন, ‘প্রতিপদ থেকে চন্ডীমন্ডপে সাতজন পুরোহিত চণ্ডী পাঠ করেন এবং বিল্ববৃক্ষে মায়ের পুজো করেন পঞ্চমী পর্যন্ত। এরপর আমন্ত্রণ- অধিবাস শেষে ষষ্ঠীতে হয় দেবীর বোধন।  কাটি গঙ্গাতে রাজ পরিবারের সদস্যরা ঘট ভরার পর রাজ পরিবারে আনুষ্ঠানিকভাবে  দুর্গাপুজোর সূচনা হয়।‘ 

এখনও কাশিমবাজার রাজবাড়িতে সপ্তমী থেকে নবমী প্রতিদিনই কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। রাজ পুরোহিত আরও জানান, ‘একসময় রাজপরিবারের দুর্গাপুজোতে দেবীর উদ্দেশ্যে পাঁঠা বলিদান প্রথা চালু থাকলেও এখন আর বলিদান প্রথা চালু নেই। তার পরিবর্তে আমরা দেবীর উদ্দেশ্যে মাছ এবং মিষ্টি  উৎসর্গ করি।‘

রাজ পরিবারে দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন প্রথমে দর্পণে হয়। এরপর অপরাজিতা পুজো শেষে দেবীকে বেহারাদের কাঁধে চাপিয়ে কাটি গঙ্গাতে  নিরঞ্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হত (বর্তমানে হাতে টানা গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়)। রাজপুরোহিত গোপাল রায় বলেন, ‘মহামায়ার মর্ত্য থেকে কৈলাসে ফেরার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য একদা রাজ পরিবারের সদস্যরা প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে নীলকন্ঠ পাখিকে উড়িয়ে দিতেন।  কিন্তু বর্তমানে সেই প্রথা আর চালু নেই।‘

নিরঞ্জন শেষে রাজ পরিবারের সদস্যরা রাজবাড়িতে ফিরে এসে সকলে পুরোহিতকে প্রণাম করে তাঁরআশীর্বাদ নেন এবং আগামী বছরের পুজোর প্রস্তুতি আবার নতুন করে শুরু হয়।