বীরভূমের তারাপীঠে আজ শ্যামা বন্দনা, দীপান্বিতার রাতে আলোয় মেতে উঠবে মহাশ্মশান
সোমবার গোটা দেশ আলোর উৎসব দীপাবলীতে মেতে উঠবে। এই দিনেই সারা দেশে মা শ্যামা বন্দনা হয়, আর সেই ঐতিহ্যের অন্যতম কেন্দ্র বীরভূমের তারাপীঠ।

আজকাল ওয়েবডেস্ক: সোমবার গোটা দেশ আলোর উৎসব দীপাবলীতে মেতে উঠবে। এই দিনেই সারা দেশে মা শ্যামা বন্দনা হয়, আর সেই ঐতিহ্যের অন্যতম কেন্দ্র বীরভূমের তারাপীঠ। এখানে দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে মা তারাকে শ্যামারূপে পূজা করা হয়। শাক্ত মতে এই রাত্রি হল মহাশক্তির আরাধনার সময়। তাই অমাবস্যা তিথি শুরু হওয়া মাত্রই শুরু হবে নিশীথকালীন কালীপুজো।
এই বছর অমাবস্যা তিথি শুরু হচ্ছে ২০ অক্টোবর দুপুর ২টো ৫৭ মিনিটে এবং শেষ হবে ২১ অক্টোবর বিকেল ৪টে ২৬ মিনিটে। তারাপীঠ মন্দিরের সভাপতি তারাময় মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সোমবার দুপুরের পর অমাবস্যা শুরু হতেই মা তারাকে কালীরূপে পুজো দেওয়া হবে। তিনি বলেন, মায়ের সন্ধ্যারতির পর মন্দিরে শীতল ভোগ নিবেদন করা হয়, তারপর নিশীথে কালীপুজো শুরু হবে রাত ১০টা ৩০ মিনিট বা ১১টার দিকে। তখন মাকে সোনার গয়না, নানা ফুলের মালা, রেশমবস্ত্র ও চন্দনের গন্ধে সাজানো হয়। সেই সময় মা তারা হয়ে ওঠেন শ্যামা—অর্থাৎ অন্ধকার থেকে আলোর পথপ্রদর্শক দেবী।
কথিত আছে তারাপীঠের মা তারার পুজোর প্রচলন করেছিলেন মহান তান্ত্রিক সাধক বামাক্ষ্যাপা। তিনি মায়ের আরাধনায় সারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন মা তারাই সর্বশক্তির প্রতীক। বামাক্ষ্যাপার তপস্যা ও সাধনার ফলেই তারাপীঠ তন্ত্রসাধনার এক প্রধান পীঠক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। বলা হয়, পরবর্তীতে মা তারা কে বিভিন্নভাবে পূজো করার পাশাপাশি শ্যামাকালী রূপেও পুজোর প্রচলন করেন, যা আজও দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে ঐতিহ্য হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন: ভূতদেরও ছুটি মেলে! আসানসোলের হাড়হিম করা ভূত চতুর্দশীর গল্প
দীপান্বিতা কালীপুজোর দিনে হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয় তারাপীঠে। অমাবস্যা শুরু হতেই মন্দির চত্ত্বর থেকে শ্মশান পর্যন্ত জনসমুদ্র দেখা যায়। সন্ধ্যারতির সময় মন্দির বন্ধ রেখে মাকে রাজরাজেশ্বরী রূপে সাজানো হয়, এরপর নিশীথ পুজোর জন্য আবার দরজা খোলে। এই সময় চারদিক ভরে ওঠে শ্যামাসঙ্গীতের সুরে—যা ভক্তদের মধ্যে আলাদা আবেগ সৃষ্টি করে।
মন্দির চত্ত্বর সাজানো হয় আলোকসজ্জা, ফুল ও প্রদীপে। ঐতিহ্য অনুযায়ী এখনও সেবাইত পরিবারের মেয়েরা ও আশপাশের মহিলারা হাতে থালা করে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে মন্দির থেকে শ্মশান পর্যন্ত সারি সাজান। আধুনিক আলোর ঝলকানির পাশাপাশি প্রদীপ ও মোমবাতির আলোয় তারাপীঠ জেগে ওঠে এক রহস্যময় আধ্যাত্মিক আলোয়।
শ্যামারূপী মা তারার ভোগও এই দিন বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। নিশীথ পুজোর পর নিবেদন করা হয় মায়ের প্রধান ভোগ—খিচুড়ি, বলি দেওয়া পাঁঠার মাংস, মাছ, কারণবারি, পাঁচরকম ভাজা, পোলাও, চাটনি, পায়েস ও মিষ্টি। সন্ধ্যারতির পর ‘শীতল ভোগে’ থাকে লুচি, সুজি, নানা ভাজা ও মিষ্টান্ন। অনেক ভক্ত নাম-গোত্রসহ মায়ের ভোগের খরচ বহন করেন, মন্দিরের তরফ থেকেও সেই ভোগ বিলি করা হয় ভক্তদের মধ্যে।
অসংখ্য পুণ্যার্থীর ভিড় সামলাতে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে। মন্দির কর্তৃপক্ষের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা নজরদারি, স্থানীয় পুলিস ও প্রশাসনের উপস্থিতি থাকে সারারাত। তারাময় মুখোপাধ্যায়ের কথায়, কালীপুজোর দিন রাতভর মন্দির খোলা থাকে, ভক্তদের পুজো দেওয়ার সুযোগ দিতে। এই রাতে গোটা দেশ থেকে তান্ত্রিক ও সাধকরা ভিড় করেন তারাপীঠ মহাশ্মশানে—যেখানে শবদাহ আর সাধনার মিলনে সৃষ্টি হয় এক অনন্য সাধনক্ষেত্র।
তন্ত্রপীঠ তারাপীঠে দীপান্বিতা কালীপুজো শুধু এক উৎসব নয়, এটি আলো ও অন্ধকার, সৃষ্টি ও বিনাশের মধ্যেকার চিরন্তন তত্ত্বের প্রতীক। সেই কারণেই প্রতি বছর এই রাতে মা তারার শ্যামারূপ দর্শনে ভক্তদের ঢল নামে বীরভূমের এই মহাশ্মশানে।