১ টাকা হাতখরচ থেকে চুনী গোস্বামীর পায়ে পড়া, পুজোর স্মৃতি হাতড়ালেন 'গানওয়ালা'

Kabir Suman: পুজো আসতে বাকি আর মাত্র ১০ দিন। এখন পুজো ঠিক কেমন কবীর সুমনের কাছে? ছোটবেলার পুজোই বা তাঁর কাছে ঠিক কেমন ছিল? অথবা পুজো এলে কোন বিষয়টি সবথেকে বেশি মনে পড়ে তাঁর? খোঁজ নিল আজকাল ডট ইন।

Bengali Famous singer Kabir Suman shares his Durga Puja memories

রাহুল মজুমদার 

পুজো আসতে বাকি আর মাত্র ১০ দিন। এখন পুজো ঠিক কেমন কবীর সুমনের কাছে? ছোটবেলার পুজোই বা তাঁর কাছে ঠিক কেমন ছিল? অথবা পুজো এলে কোন বিষয়টি সবথেকে বেশি মনে পড়ে তাঁর? খোঁজ নিল আজকাল ডট ইন। বর্ষীয়ান সঙ্গীতকারের সঙ্গে সুমনোচিত কথালাপে উঠে এল পুজোর গান, ফুটবল, লেকের ধারে ঝিরঝিরে উত্তুরে হাওয়ার ঝলমলে স্মৃতি আর চুনী গোস্বামী! এত স্পষ্ট সেসব ঘটনাবহুল গল্প শুনে কে বলে মানুষটা পঁচাত্তর! 

স্বপ্নিল জলছাপের মত ছোটবেলার পুজোর টুকরো টাকরা ঘটনা আজও স্পষ্ট সুমনের স্মৃতিতে। স্পষ্ট উচ্চারণে বলে ওঠেন, " বাঙালি পরিবেশেই বড় হয়েছি। কটকে আমার জন্ম। ওইটুকু বয়সে ওখানকার পুজো উদ্‌যাপন একেবারেই মনে নেই। তবে সেখান থেকে বছর পাঁচেক বয়সে যখন কলকাতায় এলাম আর দুর্গাপুজো দেখলাম, সত্যি বলছি মাথা ঘুরে গেল। বাপরে বাপ! তখন মুদিয়ালি ক্লাবের সামনে থাকতাম। মহালয়ার ভোরে জেগে আচার্য পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সংগীত শুনলেই মনে হত এই তো শুরু হয়ে গেল পুজো। পরদিন ভোরেই পাড়ার বন্ধুরা এক দৌড়ে লেকে ছুটে যেতাম শিউলি ফুল কুড়োতে। আর জানেন, ছোটবেলায় মা-বাবার থেকে একটি জামা, একটি হাফ-প্যান্ট আর নতুন চকচকে জুতো পেতাম। এবারে ওই নতুন জুতো জোড়া মাথার বালিশের পাশে যত্ন করে রেখে ঘুমোতাম। ওই নতুন জুতোও যেন আমার ছোটবেলার দুর্গাপুজোর অঙ্গ ছিল। বাটার জুতোর গন্ধ, জামার গন্ধ...  আর মনে পড়ে পুজোর সময় লাউডস্পিকারে সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া 'দুরন্ত ঘূর্ণি এই লেগেছে পাক' গানটি বাজতো চতুর্দিকে। পুজোর তিনটে দিন পাড়ার বন্ধুরা দল বেঁধে এপাড়া ও পাড়ায় ঠাকুর দেখতে বেরোতাম। কতই বা বয়স তখন? বড়জোর সাত। আর সাত বছর বয়স মানেই, বড় হয়ে গিয়েছি, .সোজা কথা! আর...আর ওই নতুন জুতো পরে সবার পায়ে তখন এখানে ওখানে ফোস্কা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি সবাই, নতুন জুতো হাতে নিয়ে..."  বলতে বলতে হাসি তখন পৌঁছে গিয়েছে কবীরের চোখের ভাঁজে । 

"মা রোজ এক টাকা করে হাতখরচ দিত পুজোয়। ১৯৫৬ সালে ওটাই অনেক টাকা! তখন চার আনা দিয়ে একটা কোকা কোলা খেতাম আর উজ্জ্বলা চানাচুর থেকে আরও আনা চারেকের ডালমুট কিনতাম। তারপর বন্ধুরা মিলে হইহই করে সেসব খেতাম। আহা! কীসব দিন ছিল। কী আনন্দ যে হত ওই ডালমুটের নুন দু'হাতে মেখে। যাই হোক, তবু খরচের  জন্য বাকি রইল আট আনা।  সেইটে দিয়ে তখন 'অ্যাটম বোমা' নামের একটি ক্যাপ ফাটানোর যন্ত্র পাওয়া যেত। ঠিকমতো ছাড়তে পারলে রকেটের মতো সাঁই-ই-ই-ই করে উপরে উঠে ফট করে ক্যাপটা ফেটে যেত। আর রাস্তায় যে এসব আমরা ফাটাতাম কোনও লোক কিন্তু তখন খবরদারি করত না। মানুষ না ভালবাসত একে অপরকে। রাস্তায় তখন পুলিশ থাকত তবে অনেক কম। সাধারণ মানুষ অত্যন্ত যত্নশীল ছিল"। 


সুমন-মর্জিতে ভেসে আসে আরও স্মৃতি, "পুজোতে আরও একটি খুব সুন্দর স্মৃতি রয়েছে আমার। সেটা খুব বলতে ইচ্ছে করছে। এই ফাঁকে বলে নিই। আমি ছিলাম মোহনবাগান ক্লাবের ভক্ত। আর নায়ক ছিলেন চুনী গোস্বামী। উত্তমকুমার ছিলেন না কিন্তু। দেবতা ছিলেন চুনী আমাদের কাছে। 'গুরু' বলে ডাকতাম, 'গুরু' বলে মানতাম। যদি শুনতাম কোনও গাছের তলায় চুনী দাঁড়িয়েছেন , সেই গাছের পাতা ছিঁড়ে বইয়ের পাতার ভাঁজে রেখে দিতাম। আজও আমার 'নায়ক' চুনী গোস্বামী। যখন বাংলা আধুনিক গানে নাম হল একটু আধটু এটা সেই সময়ের ঘটনা। পুজোর সময়ে বহু ক্লাবে চ্যারিটি শো করতাম। এমনই এক দুর্গাপুজোতে রবীন্দ্র সদনে উয়ারি ক্লাবের অনুরোধে একক আধুনিক গানের অনুষ্ঠান করছি। অনুষ্ঠানের আগে একা অনুশীলন করছি, সেইসময় প্রেক্ষেগৃহের একজন কর্মচারী এসে বললেন, 'স্যার, সুবিমল গোস্বামী আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন বাইরে। আমি ওঁকে দাঁড়াতে বলেছি'। শোনামাত্রই ছিলে টানা তীরের মতো লাফিয়ে উঠলাম। প্রথমে বুঝতে পারিনি, তারপর খেয়াল হতেই মনে হল, লোকটা বলে কী!  সুবিমল গোস্বামী মানে চুনী গোস্বামী? গিটারটা ছুঁড়ে ফেলে, এক ধাক্কা মেরে ওই লোকটাকে সরিয়ে দরজার দিকে পাগলের মতো ছুটলাম! দরজা খুলেই দেখি সামনে 'গুরু'।  

"আমি কোনও কথা না বলে সোজা ওঁর পায়ে পড়ে গেলাম! জোর গলায় বলছি, জীবনে একবারই কবীর সুমন কারও পায়ে পড়েছে তাঁর নাম চুনী গোস্বামী! উনি তখন রে রে করে উঠেছেন, ' আরে, সুমনবাবু একী করছেন? আমি তখন বলছি, 'পায়ে পড়ব না তো কী করব? আপনি জানেন না, আপনি কী আমার কাছে। আপনি আমার গুরু!'  শুনে 'গুরু' আবেগতাড়িত গলায় বলে উঠলেন, 'আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে'। পাল্টা বলেছিলাম, আমার আরও বেশি পাচ্ছে। তারপরেই আমাকে বুকে টেনে নিলেন তিনি..."। 


অমরত্বের প্রত্যাশা হেলায় সরিয়ে দিয়ে সারল্য, শিল্প, সৃষ্টি, প্রেম দিয়ে স্পর্শ করে ফেলা এক জীবনের নামই হয়তো কবীর সুমন। কে জানে!