মা দুর্গার হাত ধরে শিশুরূপে মহাদেব, নবদ্বীপে ২৭৩ বছরের প্রাচীন দুর্গাপুজো ‘অভায়া মা’
Durga Puja 2025: শারদোৎসবে বাংলার জেলাগুলিতে ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে আনাচেকানাচে। আর এই সমস্ত জেলার দুর্গাপুজো আজও সেই সব প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই পালিত হয়ে চলেছে।

গোপাল সাহা
শারদোৎসবে বাংলার জেলাগুলিতে ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে আনাচেকানাচে। আর এই সমস্ত জেলার দুর্গাপুজো আজও সেই সব প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই পালিত হয়ে চলেছে। আলোর রোশনাইয়ে কমবেশি ভাটা পড়লেও পুজোর রীতিনীতিতে, বনেদিয়ানায় কিঞ্চিত মাত্র ভাটা পড়েনি এই সকল সুপ্রাচীন দুর্গাপূজোগুলিতে। তাদের মধ্যেই অতিপ্রাচীন দুর্গাপুজো নদীয়া জেলার নবদ্বীপে ‘মা দুর্গা’ আসেন শিশু মহাদেবকে হাতে ধরে সঙ্গে নিয়ে ‘অভয়া মা’ রূপে, যেখানে মা দুর্গার দু’টি হাত, তিনি রূপে দশভূজা নন। আর যে পুজো হয়ে আসছে বিগত ২৭৩ বছর ধরে।
প্রাচীনকাল থেকেই নদীয়া জেলার নবদ্বীপ ধাম শুধু চৈতন্যদেবের জন্যই খ্যাত নয়, দুর্গাপুজোর এক ব্যতিক্রমী ধারা নিয়েও সমানভাবে সমৃদ্ধ। নেতাজি সুভাষ রোডের পাঁচ মাথার দক্ষিণ অঞ্চলে দুর্গার আর এক রূপ ‘অভয়া মা’। স্থানীয়রা বলেন, দেবী এখানে শুধু দুর্গা নন, তিনি অভয়া মা— ভক্তদের সুরক্ষার প্রতীক। আর তাই এই জায়গা ‘অভয়া মা তলা’ নামেই আজ পরিচিত।
আনুমানিক ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে মাটি খুঁড়তে গিয়েই মিলেছিল দেবীর এক অতি ক্ষুদ্র ধাতব মূর্তি। মাত্র ৭ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য ও ৩.৫ সেন্টিমিটার প্রস্থের এই মূর্তি এখনও পর্যন্ত নদীয়ার মধ্যে আবিষ্কৃত ধাতুমূর্তিগুলির মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম বলে দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা। দ্বিভুজা দেবী সিংহাসনে উপবিষ্ট, ডান হাতে বরাভয় মুদ্রা আর বাঁ হাতে রহস্যময় ভগ্নাংশ— পাদদেশে যেন সরীসৃপজাতীয় এক প্রাণী। পণ্ডিতদের অনুমান, সেটি গোধিকা।
মূর্তি উদ্ধারের পর তৎকালীন সমাজপতিরা শারদীয়া পুজোয় সেই ধাতব মূর্তির ধ্যানে মৃন্ময় প্রতিমা নির্মাণ করে পুজোর বিধান দেন। তারপর থেকে পুরুষানুক্রমে চলে আসছে ‘অভয়া মা’র পূজা। খোকন মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের বাড়িতে বছরভর পুজো হয় ধাতব মূর্তির, আর দুর্গাপূজার ক’দিন ‘অভয়া মা’ তলার দালান মন্দিরে মৃন্ময়ী প্রতিমার পাশে বসানো হয় দেবীর সেই ঐতিহাসিক ধাতব প্রতিমাও।
পুরাতত্ত্ববিদ শান্তিরঞ্জন দেব জানাচ্ছেন, মূর্তির আবিষ্কারের সময় এই অঞ্চলের পাশ দিয়ে বয়ে যেত গঙ্গার প্রাচীন এক শাখা। এমনকি ১৫৯০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই জলপথে নৌযান চলাচলের উল্লেখ মেলে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও। ইতিহাসের সেই ছাপ আজও দেখা যায় পরিত্যক্ত খাতে।
অভয়া দেবীর মূর্তিও রহস্যে মোড়া। মৃন্ময় প্রতিমায় দেবী সিংহাসনে ষোড়শী রূপে, ডান হাতে বরাভয় মুদ্রা আর বাঁ হাতে ধরা এক উলঙ্গ বালকের হাত। বহু পণ্ডিতই বলেন, এই বালক আসলে শিব। পুরাণ মতে, মহাদেব বারবার ভগবতীর ধ্যান ভঙ্গ করতে গিয়ে অবশেষে বালক রূপে তাঁর সামনে দাঁড়ান। দেবী তাকে ডান হাতে আশীর্বাদ দেন, আর বাঁ হাতে ধরে রাখেন যাতে তিনি আর পালাতে না পারেন। সেই থেকে তাঁর নাম হয় ‘অভয়া মা’।
এই মন্দির আজ নবদ্বীপ শহরের হেরিটেজ তালিকাভুক্ত। সম্প্রতি নিত্যপুজোর সুবিধার্থে ধাতব মূর্তির আদলে এক পাথরের প্রতিমাও স্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা কুন্তী দাস বলেন, “আমাদের ‘অভয়া মা’ খুব জাগ্রত। যা চাই সবই দেন তিনি। অষ্টমীতে ভোররাত থেকেই হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান।”
সেবায়েত বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “অষ্টমীর দিন রাত ২টো থেকেই লাইন পড়ে। দূরদূরান্ত থেকে প্রায় ২৫ হাজার ভক্ত এক সঙ্গে পুজো দেন অভয়া মায়ের চরণে।”
ব্রিটিশ আমল থেকে আজও সমান জাঁকজমকে হয়ে আসছে এই পূজা। ভক্তদের বিশ্বাস, যাঁর এক হাত আশীর্বাদে প্রসারিত, যাঁর নামেই মেলে ভয়ের অবসান, সেই ‘অভয়া মা’ নবদ্বীপের মানুষকে আজও রক্ষা করছেন তাঁর আশ্চর্য শক্তিতে।