পাহাড়ে ঘনঘন কামানের আওয়াজের শুনলেই বোঝা যায় দুর্গাপুজোর সূচনা হল রাজবাড়িতে

Durga Puja 2025: মুর্ছা পাহাড় থেকে মুহুর্মুহু কামানের গর্জন, আর তার সঙ্গেই সূচনা হয় ঐতিহ্যবাহী মল্লরাজ কুলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো।

Durga Puja 2025: Durga Puja of king Malla starts with the sound of canon
ঐতিহ্যবাহী মল্লরাজ কুলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো। নিজস্ব চিত্র।

আজকাল ওয়েবডেস্ক: মুর্ছা পাহাড় থেকে মুহুর্মুহু কামানের গর্জন, আর তার সঙ্গেই সূচনা হয় ঐতিহ্যবাহী মল্লরাজ কুলদেবী মৃন্ময়ীর পুজো। ন’টি তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষের বার্তা ছড়িয়ে পড়তেই রাজবাড়ির ভাঙাচোরা দেওয়ালে যেন আবারও ফিরে আসে ইতিহাসের পদচারণা। মল্লরাজারা আজ আর নেই, তাঁদের রাজ্যপাটও নেই। কিন্তু তাঁদের রেখে যাওয়া রীতিনীতি আজও অটুট বিষ্ণুপুরের রাজপরিবারে।

এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘পট পুজো’। প্রথা মেনে প্রতি বছর শহরের শাঁখারি বাজারের ফৌজদার পরিবারের সদস্যরা আঁকেন তিন ঠাকুরাণীর পট— বড় ঠাকুরাণী মহাকালী, মেজ ঠাকুরাণী মহালক্ষ্মী এবং ছোটো ঠাকুরাণী মহাসরস্বতী। মৃন্ময়ী প্রতিমার পাশে নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে পূজিতা হন তারা। মল্লরাজাদের হস্তলিখিত বলিনারায়ণী পুথি অনুযায়ী, তিন ঠাকুরাণী মহামায়ার রূপে পূজিতা হন। প্রথা অনুযায়ী, দেবীপক্ষের চতুর্থীতে মেজ ঠাকুরাণীর পুজো শুরু হয়। সপ্তমী থেকে ছোটো ঠাকুরাণীর পুজো আরম্ভ হলেও সূচনা হয় বড় ঠাকুরাণীর মাধ্যমেই। জীতাষ্টমীর পরের দিন স্থানীয় পুকুরে পুজো সেরে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্দিরে আনা হয় বড় ঠাকুরাণীর পট। প্রতিটি নির্ঘণ্ট ঘোষিত হয় কামানের বজ্রনির্ঘোষে।

ইতিহাস বলছে, ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে জগৎমল্ল বিষ্ণুপুরে আগমন করেন। অলৌকিক এক ঘটনার পর দেবী মৃন্ময়ী তাঁকে রাজধানী স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। প্রদ্যুম্নপুর থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় বিষ্ণুপুরে। গড়ে ওঠে মৃন্ময়ী মন্দির। রাজ্যের সমৃদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মৃন্ময়ীর পুজোও রাজকীয় আভিজাত্যে হয়ে ওঠে অনন্য। আজও সেই ঐতিহ্য বহন করছে বিষ্ণুপুর। রাজপরিবারের সদস্যরা ও রাজপুরোহিত স্থানীয় পুকুরে পুজো সেরে আনেন তিন ঠাকুরাণীর পট। কামানের গর্জনে ছড়িয়ে পড়ে দেবী আগমনের বার্তা। শুধু স্থানীয় মানুষই নয়, দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকরাও এই সময়ে ভিড় জমান মন্দির নগরীতে। ঐতিহ্যের টানে বিষ্ণুপুর আজও মল্লরাজাদের গৌরবগাথা বহন করছে।

রাজপরিবারের সদস্য জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ ঠাকুর বলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষরা যে ঐতিহ্য শুরু করেছিলেন, তা আজও আমরা ভক্তিভরে পালন করি। এটি শুধু রাজপরিবার নয়, সমগ্র বিষ্ণুপুরের গৌরব।”

বিষ্ণুপুর মল্লরাজ পুরোহিত সোমনাথ মুখার্জীর কথায়, “মৃন্ময়ী পুজো শুধু ধর্মীয় আচার নয়। এটি রাজপরিবারের ইতিহাস ও মল্ল সংস্কৃতির অঙ্গ।”

যা সমর্থন করে বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা তাপসী বিশ্বাস জানান, “আমরা এই পুজোকে শুধু উৎসব নয়, আমাদের শহরের আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক ঐতিহ্য হিসেবে দেখি।”

অন্যদিকে, পুজোকে কেন্দ্র করে বিষ্ণুপুর শহরে উৎসবের আবহ তৈরি হয়। মৃন্ময়ী পুজোর দিনগুলিতে শহরের অলিগলি, রাজবাড়ি চত্বর ও মন্দিরপ্রাঙ্গণ রঙে-আলোয় ভরে ওঠে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা যেমন এই সময়ে নানা আয়োজন করেন। তেমনই হস্তশিল্পীদের জন্যও এটি বছরের অন্যতম ব্যস্ত সময়। বিষ্ণুপুরের খ্যাতনামা টেরাকোটা শিল্প, লণ্ঠন, শাঁখশিল্প, মাটির খেলনা ও দশাবতার তাসের চাহিদা বাড়ে বহুগুণ। শুধু পুজোর সঙ্গে সম্পর্কিত সামগ্রীই নয়, পর্যটকদের জন্য ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প সামগ্রীও বিপুল পরিমাণে বিক্রি হয়।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের ভিড় শহরে নতুন প্রাণসঞ্চার করে। হোটেল-লজ থেকে শুরু করে খাবারের দোকান, পরিবহন পরিষেবা—সব ক্ষেত্রেই তখন বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি হয়। অনেক পরিবার এই সময়টিকেই সারা বছরের আয়ের ভরসা হিসেবে দেখেন। ফলে মৃন্ময়ী পুজো শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি স্থানীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে।

এই পুজোকে ঘিরে শহরের সাংস্কৃতিক পরিবেশও নতুন মাত্রা পায়। পর্যটকরা স্থানীয় শিল্পকলা ও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। স্থানীয় সঙ্গীত, নৃত্য ও নাট্যানুষ্ঠানও এই সময়ে আয়োজন করা হয়, যা বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসে। ফলে মৃন্ময়ী পুজোকে ঘিরে বিষ্ণুপুরে যেন এক সঙ্গে জাগে ভক্তি, উৎসব, শিল্প, ঐতিহ্য ও অর্থনীতির সজীব স্রোত।