ভুবনডাঙার এই পুজোর জন্য রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ এগিয়ে এসেছিলেন আর্থিক সহায়তা নিয়ে

একদল তরুণ এগিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন ভুবনডাঙা আদি সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটি। তাঁদের হাতে গড়া সেই উদ্যোগই আজ বোলপুরের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোর আসর।

Daughter-in-law of Rabindranath Tagore financially helped the Puja committee
বোলপুরের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোর আসর

আজকাল ওয়েবডেস্ক: স্বাধীনতার আগেকার কথা। বোলপুর শহরে তখন হাতে গোনা কয়েকটি দুর্গাপুজো হত। ভুবনডাঙার মানুষদের নিজেদের এলাকায় কোনও সর্বজনীন দুর্গাপুজো না থাকায় এলাকার কচিকাঁচা ও গৃহবধূদের ভিন্ন এলাকায় গিয়ে পুজো দেখতে হত। এই অভাব ঘোচাতে এলাকার একদল তরুণ এগিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন ভুবনডাঙা আদি সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটি। তাঁদের হাতে গড়া সেই উদ্যোগই আজ বোলপুরের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোর আসর।

১৯৪৫ সালে ভুবনডাঙায় প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা হয় মাটির চালাঘরে। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে ছিলেন দিবাকর হাজরা, নিশাপতি মাঝি, দ্বিজপদ হাজরা, অভয়পদ রায়, শ্যামাপদ হাজরা প্রমুখ। তবে এই ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথের পত্নী প্রতিমাদেবী সেই সময় ভুবনডাঙার দুর্গাপুজো কমিটিকে উৎসাহ দিতে ১০০ টাকা দান করেছিলেন। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে একশো টাকা ছিল এক বিরাট অঙ্কের অর্থ। কিন্তু কেবল টাকার পরিমাণেই এই দানের তাৎপর্য সীমাবদ্ধ নয়। কারণ, তৎকালীন সময়ে বিশ্বভারতীর অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত থাকায় শান্তিনিকেতনের অভ্যন্তরে মূর্তি পুজো প্রচলিত ছিল না। ফলে আশ্রমিকরা ও ঠাকুর পরিবারের বহু সদস্য ভুবনডাঙার এই দুর্গাপুজোতে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতেন। প্রতিমা দেবীর সেই আর্থিক সহায়তা তাই ছিল এক ঐতিহাসিক প্রেরণা। যা আশ্রমিকদের কাছে এই পুজোকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে এবং গ্রামবাসীর উৎসাহকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। সেই থেকেই ভুবনডাঙার দুর্গাপুজো ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন মিলনমেলা।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কমিটি শুধুই পুজোয় সীমাবদ্ধ থাকেনি। ২০০১ সালে নাটমন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পুজোর আয়োজনকে আরও গৌরবান্বিত করা হয়। পাশাপাশি সারাবছর ধরে নানা সমাজসেবামূলক কাজে সক্রিয় থেকেছে কমিটি। দুঃস্থদের বস্ত্রদান, শীতবস্ত্র বিতরণ, বৃক্ষরোপণ, রক্তদান শিবির, স্বাস্থ্যশিবির থেকে শুরু করে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার মতো নানা উদ্যোগ আজও এই কমিটির প্রধান কাজ।

বর্তমানে ভুবনডাঙার প্রায় প্রতিটি পরিবার কোনও না কোনওভাবে যুক্ত রয়েছে এই দুর্গাপুজোর সঙ্গে। বর্তমান কাউন্সিলর সুকান্ত হাজরা নিয়মিতভাবে অংশ নেন কমিটির কর্মকাণ্ডে। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা আর নবীনদের উদ্যম মিলিয়ে ভুবনডাঙা আদি সর্বজনীন দুর্গাপুজো আজ এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে।

এবার এই দুর্গাপুজো ৮১ বছরে পা দিল। সাবেক প্রতিমার পাশাপাশি গ্রামীণ পসরা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে মন্ডপের প্রবেশ পথ। ইতিহাসের পাতায় ভুবনডাঙার দুর্গাপুজো তাই কেবল এক গ্রামীণ উদ্যোগের গল্প নয়, বরং সেই ঐতিহ্য যেখানে প্রতিমা দেবীর দান হয়ে উঠেছিল প্রেরণার আলো‌। আর বিশ্বভারতীতে মূর্তি পুজোর অভাব ভুবনডাঙাকে করেছিল আশ্রমিক ও ঠাকুর পরিবারের মিলনক্ষেত্র। সেই সর্বজনীন ঐতিহ্য আজও সমান গৌরবে বহমান।