অভাবের ‘অসুর’ বধে কাজ নিয়েছেন শ্মশানে, হার না মানা মনোভাবই সঙ্গী বলে জানাচ্ছেন রাজ্যের প্রথম মহিলা ডোম টুম্পা
Durga Puja 2025: দক্ষিণ ২৪ পরগনা বারুইপুরের টুম্পা দাস। এরাজ্যে তিনিই প্রথম মহিলা ডোম। তাঁর বাবা ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার বারুইপুর পুরন্দরপুর মহাশ্মশানের ডোম।

আজকাল ওয়েবডেস্ক: দক্ষিণ ২৪ পরগনা বারুইপুরের টুম্পা দাস। এরাজ্যে তিনিই প্রথম মহিলা ডোম। তাঁর বাবা ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার বারুইপুর পুরন্দরপুর মহাশ্মশানের ডোম। তাঁর মৃত্যুর পর সংসারের চাপ সামাল দিতে এখন টুম্পা বেছে নিয়েছেন বাবার পেশাকে।
গত ১০ বছর ধরে চলে আসছে টুম্পার জীবন সংগ্রাম। এতটুকু না থেমে। দিন এবং রাত, প্রিয়জনকে শেষ বিদায় দেওয়ার সময় যখন শ্মশানে শোনা যায় বুকফাটা কান্না, তখন অবিচল থেকে নিজের কর্তব্য করে যান টুম্পা। অন্যান্য উৎসব বা দুর্গাপুজো, তাঁর জীবনে কোনো বৈচিত্র্য নেই। দুর্গাপুজোর দিনগুলোতে যখন অন্যরা নতুন পোশাকে বাড়ির সবাইকে নিয়ে হইহুল্লোড়ে মেতে থাকেন তখন টুম্পা শ্মশানে বসে অপেক্ষা করেন কখন আসবে শবদেহ।
ইচ্ছা কি হয় না বাইরে আলোর বলয়ের মধ্যে কিছুটা হই চই করে আসতে? টুম্পা বলেন, “ইচ্ছা হয় বন্ধুদের সঙ্গে বা পরিবারের সঙ্গে পুজো মণ্ডপে যাই। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে আমার জন্য পুজো মণ্ডপের ‘দরজা’ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ষষ্ঠী থেকে অষ্টমী, অঞ্জলি থেকে মায়ের কাছে বসে আড্ডা, কিছুই নেই আমার জীবনে। বাবা মারা যাবার পর থেকেই সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে আমার কাঁধে। আগে তো ২৪ ঘণ্টা ডিউটি ছিল। এখন ইলেকট্রিক চুল্লি চালু হওয়ার পর ১২ ঘণ্টা ডিউটি হয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর সেটা সামলাতে কয়েক বছর কেটে যায়। তারপরে আর ইচ্ছা হলেও পুজোমণ্ডপে গিয়ে মায়ের কাছে বসে থাকা বা আড্ডা মারা আমার কপালে জোটেনি। আমি দূর থেকে শুনতে পাই মা আসছে এবং এসেছে। আবার হঠাৎ করেই দেখতে পারি আমার শ্মশানের পাশের আদি গঙ্গায় মায়ের মূর্তিগুলো ফেলে দিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন বুঝি মা চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের আর মায়ের কাছে যাওয়া হয় না।”
একা হাতেই বারুইপুরের পুরন্দপুরের মহাশ্মশানের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন বছর ২৯-এর এই মহিলা ডোম। নাম নথিভুক্ত থেকে চুল্লিতে ঢোকানো পর্যন্ত সবটাই নিজের দায়িত্বে পালন করে আসছেন তিনি। কল্যাণপুর অঞ্চলের পুরন্দরপুরেই তাঁর বাড়ি। ছোট বোন, মা ও ভাইকে নিয়ে তাঁর সংসার।
সংসার বাঁচাতে কোনও ভয়ভীতিকেই মনে আমল দেননি এই টুম্পা। কর্তব্যে অবিচল থেকে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দেহ সৎকার করে চলেন তিনি। মাসিক বেতন সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। এখন শ্মশানে বসেছে ইলেকট্রিক চুল্লি। তার আগে কাঠের চুল্লিতেই হত শেষকৃত্য। নিজের হাতে সেই কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে টুম্পার।
তাঁর কথায়, “কোনও কাজই কঠিন বলে ভাবা ঠিক নয়। বাবা মারা যাওয়ার পর ভেবেছি সংসারকে বাঁচাতে হবে। তাই যে করেই হোক এই কাজ করতে হবে। প্রথম প্রথম একটু ভয় লাগত কিন্তু এখন আর হয় ভয় হয় না। পরিস্থিতি ও সময় থেকেই শিখেছি। মৃত মানুষের থেকে জীবিত মানুষকে নিয়ে ভয় বেশি। যদিও সেই পরোয়াও নেই। সব প্রতিকূলতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি। এখন শ্মশানের ভিতর বেশি সুরক্ষিত বলে মনে করি।” বিয়ের সম্পর্কের জন্য একাধিক প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু তাঁর কাজ সম্পর্কে জেনেই অনেকেই পিছু হটে গিয়েছেন। তাতেও তাঁর কোনও কষ্ট নেই। কারণ দিনের শেষে সংসার সংগ্রামে তিনি জয়ী হন। রাজ্যের একমাত্র মহিলা ডোম হিসেবে তাঁর একটাই আবেদন যদি এই কাজটা সরকার স্থায়ী করে দেয় তাহলে খুব ভাল হয়।