লাল দুর্গা, গাঢ় নীল গণেশ! চক্রবর্তী পরিবারের ৩০০ বছরের পুজো শুরু কীভাবে? জানুন ইতিহাস 

Durga Puja: প্রাক-বিভাজনের ঢাকা থেকে শুরু হয়ে আজকের সল্টলেক পর্যন্ত এই পুজো পৌঁছে দিয়েছে এক অনন্য কাহিনি—যেখানে ভেসে ওঠে সংগ্রাম, অভিযোজন ও এক নীরব বিপ্লবের গল্প।

History of 300 years running Chakravarty Durga Puja 

ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে, পুজো শুরু। কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোর ইতিহাস জানতে কার না মন চায়? ৩০০ বছরের পুরনো পুজো চক্রবর্তী বাড়ির। 
চক্রবর্তী পরিবারের দুর্গাপূজা কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এক উত্তরাধিকার, এক দৃঢ়তার প্রতীক। প্রাক-বিভাজনের ঢাকা থেকে শুরু হয়ে আজকের সল্টলেক পর্যন্ত এই পুজো পৌঁছে দিয়েছে এক অনন্য কাহিনি—যেখানে ভেসে ওঠে সংগ্রাম, অভিযোজন ও এক নীরব বিপ্লবের গল্প।


এই পুজার সূচনা হয়েছিল ঢাকার শোলাঘরে, বিশাল ১৬ ফুট প্রতিমা দিয়ে। দেশভাগের পর ঐতিহ্যকে ভেসে আনা হয় কলকাতায়—প্রথমে উল্টোডাঙার একটি আচার কারখানায়, পরে ভবানীপুরে, আর শেষে সল্টলেকে। ভৌগোলিক পরিবর্তন সত্ত্বেও পূজা হারায়নি তার প্রাণশক্তি; বরং আরও দৃঢ় হয়েছে বিশ্বাসের শিকড়।

এই পুজার অন্যতম কেন্দ্র একটি নারায়ণ শালগ্রাম। এই শিলার বয়স আট শতাব্দীরও বেশি বলে মনে করা হয়। একসময় এটি হারিয়ে যায়, আর পরিবারের কর্তা স্বপ্নে তাঁর অবস্থান পান। স্বপ্নেই দেখা যায় দুর্গার রূপ—তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, অর্থাৎ গলিত সোনার আভাযুক্ত দেবী। আজও সেই আভা প্রতিমায় অটুট। প্রতিমার রং লালচে। 


প্রথাগত বলি প্রথা সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছে। ক্ষিতিশ চন্দ্র চক্রবর্তী পশুবলির পরিবর্তে মাটির তৈরি পুতুল বলি চালু করেন। নাম দেওয়া হয় 'শত্রু-নিধন'—যা আসলে মনের ভিতরের দোষত্রুটি ও অশুভ প্রবৃত্তির বিনাশের প্রতীক। সহিংসতা থেকে করুণায় উত্তরণের এই রূপান্তর ছিল এক নীরব কিন্তু শক্তিশালী পরিবর্তন।


সবচেয়ে অনন্য মুহূর্ত এসেছিল পরিবারের বিধবা সদস্যের হাত ধরে। সামাজিক রীতিতে তিনি অঞ্জলী দিতে পারতেন না, কিন্তু অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সেই নিষেধ ভেঙে দেন। ওই নারীর অশ্রুসিক্ত পুষ্পাঞ্জলি হয়ে ওঠে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত—একজন বিধবার হাত ধরে বহু শতাব্দীর সামাজিক প্রথার বাঁধন ভেঙে যায়।

পরিবারের গণেশমূর্তিতেও এসেছে পরিবর্তন। বহু বছর সোনালি রঙে তৈরি হলেও ২০০৪ সালে স্বপ্নাদেশে তাঁর রূপ হয় গাঢ় নীল। এটি বিরল আধ্যাত্মিক রূপ উচ্ছিষ্ট গণপতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রতীক। ঐতিহ্য বজায় রেখেও পরিবর্তনের এই পথ খুঁজে পাওয়া পরিবারের সাহসী সিদ্ধান্তকে প্রকাশ করে।


এই পুজো শুধু উত্তরাধিকার সূত্রে চালু নয়; বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞান, আবেগ আর দায়িত্ব হস্তান্তরের মাধ্যমে টিকে আছে। এই পুজোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এর দ্বৈততা। একদিকে সুকুমার চক্রবর্তীর কঠোর আচারনিষ্ঠা, অন্যদিকে অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি—এই দুই বিপরীত শক্তির সংমিশ্রণ পূজাকে দিয়েছে গভীরতা ও স্থায়িত্ব।


চক্রবর্তী পরিবারের দুর্গাপূজা তাই কেবল রাজবাড়ির ঐতিহ্য নয়, বরং এক মধ্যবিত্ত ঘরে বাঁচিয়ে রাখা জীবন্ত উত্তরাধিকার। এখানে রয়েছে প্রতিবাদের গল্প, সংস্কারের ভাঙন, পরিবর্তনের সাহস আর বিশ্বাসের স্থিতিশীলতা। আজকের দিনে, যখন যৌথপরিবার ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, তখনও এই পুজা তাঁদের একসূত্রে গেঁথে রাখে। শিকড়ের টান আর আধ্যাত্মিক সংযোগ মিলিয়ে এই পুজো হয়ে উঠেছে আধুনিক প্রজন্মের কাছেও প্রাসঙ্গিক।

তাই বলাই যায় চক্রবর্তী পরিবারের দুর্গাপূজা তাই শুধুই একটি পূজা নয়; এটি এক চলমান কাহিনি—যেখানে ঐতিহ্য, প্রতিরোধ ও ভালবাসা মিলেমিশে তৈরি করেছে এক চিরন্তন সেতু।