হামিদ মাস্টার
বাজারে এসে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন হামিদ মাস্টার। ওখানে উপস্থিত মানুষজন দ্রুত ধরাধরি করে হাত পঞ্চাশেক দূরের এক ডাক্তারখানায় নিয়ে এলেন। কোয়াক ডাক্তার রফিকুল পরিচিত রোগীর নাড়ি দেখলেন, রক্তের প্রেশারটা মাপলেন। প্রেসারটা একটু কমই। তবে এই কমে ভয়ের তেমন কিছু নেই। ভাবলেন, ডায়াবেটিসের রোগী। রক্তে শর্করা কমে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে স্যালাইনটা চালিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবু। ততক্ষণে পরিচিত কেউ একজন হামিদ মাস্টারের বাড়িতে ফোন করে খবরটা জানিয়ে দিয়েছেন।
জনাব আলি
বাজারে এসে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন হামিদ মাস্টার। ওখানে উপস্থিত মানুষজন দ্রুত ধরাধরি করে হাত পঞ্চাশেক দূরের এক ডাক্তারখানায় নিয়ে এলেন। কোয়াক ডাক্তার রফিকুল পরিচিত রোগীর নাড়ি দেখলেন, রক্তের প্রেশারটা মাপলেন। প্রেসারটা একটু কমই। তবে এই কমে ভয়ের তেমন কিছু নেই। ভাবলেন, ডায়াবেটিসের রোগী। রক্তে শর্করা কমে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে স্যালাইনটা চালিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবু। ততক্ষণে পরিচিত কেউ একজন হামিদ মাস্টারের বাড়িতে ফোন করে খবরটা জানিয়ে দিয়েছেন।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই বাইকে চলে এল হামিদ মাস্টারের বড় ছেলে মনিরুল। সামনের ভিড়টা ঠেলে বাবার মাথার কাছে এসে দাঁড়াল। হাতের চেটোয় কপালের ঘামটা মুছে নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল, 'কী হয়েছে?'
রোগীর পাশে প্লাসটিকের চেয়ারে বসে থাকা ডাক্তারবাবু জানালেন, 'কী আবার হবে, ওই সুগার ফল করেছে। এত বলি বেশিক্ষণ খালি পেটে থাকবেন না, শোনে কথা!'
'শুধু কী আপনার, বাড়ি কারও কথা শুনতে চায় না।' মনিরুল জানতে চাইল, 'অসুবিধার কিছু নেই তো?'
নিজের ভেতর একটু ভেবে নিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, 'অসুবিধার তেমন কিছু এখনও দেখছি না। স্যালাইনটা চলুক। প্রয়োজন হলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।'
কাঠের টুলটা টেনে নিয়ে বাবার মাথার কাছে বসল মনিরুল। ততক্ষণে খবরটা শুনে অনেকেই ডাক্তারখানায় ভিড় করে ফেলেছে। এলাকার এক সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন হামিদ মাস্টার। বছর তিনেক হয়েছে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। সকালের দিকে বাড়ির ছাদ বাগানে টুকটাক কাজ করেন। দুপুরে বিশ্রাম নিয়ে বিকালের দিকে বাড়ি থেকে সাইকেলটা নিয়ে বের হন। তারপর হাফ মাইল দূরের এই 'বটতলা' বাজারটায় আসেন তিনি। বাজারে ওই 'রূপালি বস্ত্রালয়েই' বসেন। আজও বসেছিলেন তিনি। ওই দোকানেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ওই দোকানে তাঁর পরিচিত অনেকেই আসেন। তাঁদের সঙ্গে গল্পগুজব করেন। তারপর রাত আটটার দিকে বাড়ি ফেরেন।
ডাক্তারবাবু ফের নাড়িটা দেখলেন। দু'তিন বার 'মাস্টারমশাই' বলে ডাকলেনও। কোনও সাড়াশব্দ পেলেন না। এবার স্যালাইনের গতিটা একটু বাড়িয়ে দিলেন।
মনের মধ্যে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে একটা ভয় চেপে বসেছে মনিরুলের। বয়স হয়েছে, দীর্ঘ বছরের ডায়াবেটিস, কী যে হবে! ভয়ের গলায় ফের ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেমন বুঝছেন?'
'এখনও ভয়ের কিছু দেখছি না।' ডাক্তারবাবু বললেন।
হামিদের ছোট ভাই এই বাজারেই ছিলেন। খবরটা শুনেই দ্রুত পায়ে চলে এলেন। ভিড়টা ঠেলে এগিয়ে এসে ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেমন দেখছেন?'
ডাক্তারবাবু নিজের ঘাড়টা ঘুরিয়ে বললেন, 'আরও একটু অপেক্ষা করে দেখি।'
মা'কে সঙ্গে নিয়ে হামিদ মাস্টারের ছোট ছেলে রবিউল চলে এল ডাক্তারখানায়। ভিড়ের মধ্যে অনেকেই সরে গিয়ে তাঁদের ঢোকার পথ করে দিল। ছেলের পিছন পিছন আমিনাও ঢুকে এল। কাঁদো কাঁদো স্বরে রবিউল বলে উঠল, 'কী হয়েছে?'
ডাক্তারবাবুর কিছু বলার আগেই মনিরুল বলে উঠল, 'ফের সুগার ফল করেছে।'
ডাক্তারবাবু রোগীর অবস্থা দেখে বলে উঠলেন, 'বোধহয় আরও স্যালাইন দিতে হতে পারে।'
টুল থেকে উঠে দাঁড়াল মনিরুল, 'মা তুমি বসো।'
'না, তুই বোস।' আমিনা বললেন।
আমিনা স্বামীর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে একভাবে স্বামীকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তাঁদের এই বিয়াল্লিশ বছরের সংসার। মানুষটাকে তাঁর মতো আর কেউ চেনেন না। তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কটা খুব একটা ভাল ছিল না। প্রায়ই ঝগড়া লেগেই থাকত। ক'বার তো সংসার ফেলে বাপের বাড়ি চলেও গিয়েছিলেন তিনি। স্বামী তাঁর আত্মীয়-স্বজন পাঠিয়ে তাঁকে নিয়ে নিয়ে আসতেন। শেষ বার যাওয়ার পর ভেবেছিলেন, আর তিনি স্বামীর সংসারটা করবেনই না। তবুও শেষে সন্তান দুটোর কথা ভেবে স্বামীর সংসারে ফিরে এসেছিলেন। প্রথম থেকেই বড় সন্দেহ বাতিক ছিলেন তাঁর স্বামী। সব কিছুতেই সন্দেহ করতেন। তবে এই এত বছর মানুষটার সঙ্গে একসঙ্গে কাটানোর ফলে কোথাও যেন একটা মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন। আঙুলের ডগা দিয়ে নিজের ভিজে চোখ মুছে নিলেন। তারপর ডাক্তারবাবুর কাছে জানতে চাইলেন, 'অসুবিধার কিছু নেই তো?'
ডাক্তারবাবু নিজের মুখটা উঁচু করে বললেন, 'তেমন কিছু দেখছি না। তবে--'
'থামলেন কেন? তবে কী?' আমিনা ভয়ের গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
একটুক্ষণ চুপ থেকে চিন্তিত গলায় ডাক্তারবাবু বললেন, 'এতক্ষণে জ্ঞানটা ফেরারই কথা! আগেও তো এমনটা হয়েছে! কিন্তু এতক্ষণ...!'
ডাক্তারবাবুর এমন কথায় নিজের ভেতর কেমন যেন নড়ে উঠলেন আমিনা। একটা হারানোর ভয় চেপে বসেছে মনে। মানুষটার বয়স হয়েছে। ডায়াবেটিসটাও কম দিন হল না। এই সতেরো বছর। এত দিনে অন্য কোনও বড় ধরনের রোগ শরীরে বাসা বাঁধেনি তো? এক দৃষ্টে স্বামীর চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। একসময় দেখলেন, স্বামীর চোখের পাতা দুটো যেন একটু নড়ে উঠল। ভাবলেন, এবার বোধহয় স্বামীর জ্ঞান ফিরবে। পরক্ষণে দেখলেন স্বামী তাঁর চোখের পাতা দুটো খুলে তৎক্ষণাৎ বুজিয়ে ফেললেন। স্বামীর এমন আচরণে একটা খটকা লাগল তাঁর মনে। তাহলে কি অজ্ঞান হওয়ার ভান করে আছে? ভান করার স্বভাব তাঁর স্বামীর বহুদিনের। তাছাড়া একটু কিছু হলেই এমন করবে যেন এই বুঝি মরেই গেল। হেসে ফেলতে গিয়েও চেপে ধরলেন। ভাবলেন, এই অবস্থায় লোকজনের সামনে হেসে ফেললে সে-এক কেলেঙ্কারি হবে। উপস্থিত সবাই তাঁকে খারাপ ভাববে। ডাক্তারবাবুর মুখের দিকে ফিরে বললেন, 'দরকার হলে আরও কয়েকটা স্যালাইন দেবেন।'
ডাক্তারবাবু আমিনার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, 'দরকার হবে কি?'
হালকা ব্যাঙ্গের স্বরে আমিনা বললেন, 'হতেও তো পারে!'
মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে রবিউল বলে উঠল, 'যা যা দরকার, সব কিছুই করুন।'
ডাক্তারবাবু ফের রোগীর নাড়ি দেখলেন, রক্তের প্রেসারটা মাপলেন। তারপর স্বস্তির স্বরে বললেন, 'সব কিছুই ঠিকঠাক আছে।'
এদিকে হামিদ মাস্টার বুঝে নিচ্ছিলেন তাঁর প্রতি ছেলে-বউ-ভাইদের মায়া, দায়িত্ব, কর্তব্য কেমন। অবশ্যই রক্তে শর্করা কমে যাওয়ার কারণেই তিনি অজ্ঞান হয়েছিলেন। তবে এখন তিনি সজ্ঞানেই আছেন। মারা যাওয়ার পরে তিনি তো আর নিজের চোখে পরখ করে দেখে যেতে পারবেন না। তাই এই সুযোগটা তিনি কাজে লাগাচ্ছেন। আগের ক'বারে এই বুদ্ধিটা তাঁর মাথায় আসেনি। এই বারে তিনি আর ভুলটা করেননি। একটুক্ষণ চোখ খুলেই মাথার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকালেন। শাড়ির আঁচলে নিজের চোখ-মুখ ঢেকে ফেললেন আমিনা। হামিদ মাস্টার ভাবলেন, তাঁর জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছেন তাঁর বউ। লোকজনের সামনে তো আর চিৎকার করে কাঁদাটা মানায় না। বরং তা আদিখ্যেতা মনে হবে। যাক, স্বামীর জন্য স্ত্রীর মনের কোথাও একটা মায়ার জায়গাটা আছে এতদিনে। তাঁর ভুল ধারণাটা ভাঙল আজ। তিনি তো ভাবতেন, অন্যদের মতো তাঁর স্ত্রী স্বামী ভক্ত নয়। বরং তিনি যেন দু'চোখের বিষ। তিনি নিজের মনের কাছে বেশ আশ্বস্ত হলেন। এবার তিনি মরে গেলেও আক্ষেপটা আর রইল না। চারিপাশের মানুষ ভাববে তাঁদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি যাই হোক, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসাটা শেষ হয়ে যায়নি।
এবার ছেলে ও ভাইদের নিয়ে ভাবছেন হামিদ মাস্টার। তাঁর জন্য ওদের অভিব্যক্তিগুলো কেমন। তাঁরা তিন ভাই। ছোট ভাইটা তবু এল। ডাক্তারবাবুর কাছে তাঁর সম্পর্কে খোঁজও নিল। মেজো ভাইটা তো এলই না! তাহলে কি তাঁর খবরটা পায়নি? না, খবর পেয়েও আসেনি? অকালে বাবা মারা যাওয়ার পর তিনিই ভাই দুটোকে মানুষ করেছেন। আর ছেলে দুটো? ওরা তবু তাঁর জন্য 'আ হূ' করছে। যাক তিনি মারা গেলে ওরা নিশ্চয় কান্নাকাটি করবে। আর থাকে দুটো বৌমা। এখনও ওদের কথা তিনি শুনতে পেলেন না। তাহলে ওরা আসেনি? এইটুকু পথ। দু-দুটো বাইক এল। ওরা এল না? ভাবলেন, ওরা পরের মেয়ে, যতই তিনি মায়া করেন, এটা-ওটা এনে দেন, সেসব ভুলেই মেরে দিয়েছে।
ইতিমধ্যে তিন নম্বর স্যালাইনটাও শেষের মুখে। এখনও জ্ঞান ফিরল না মানুষটার। কোথাও একটা ধন্দে পড়েছেন ডাক্তারবাবু। মনে মনে ভয়ও পাচ্ছেন। যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়! ওর চেয়ে বরং 'তার দ্বারা হবে না' বলে দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেই বোধহয় ভাল হবে। আমিনার দিকে ফিরে ডাক্তারবাবু নিজের কানের ধার চুলকাতে চুলকাতে বললেন, 'এতক্ষণ তো জ্ঞানটা ফেরারই কথা!'
আমিনা আত্মবিশ্বাসের সুরে বললেন, 'ফিরবে, নিশ্চয় ফিরবে।'
ফিরবে! আমিনার মুখের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলেন ডাক্তারবাবু। এতটা শিওর হচ্ছেন কি করে? নিজের ভেতর ধন্দে পড়ে গেলেন তিনি।
এদিকে স্ত্রীর এমন কথায় চমকে উঠলেন হামিদ মাস্টার। তাহলে কি তাঁর অজ্ঞান হওয়ার ভান করে থাকার বিষয়টা ধরে ফেলেছে? তাঁর স্ত্রীকে তিনি ভালোমতোই চেনেন। খুব ধুরন্ধর! তাহলে কিছুক্ষণ আগে শাড়ির আঁচলের তলায় না কেঁদে কি মুখ টিপে হাসছিল? ভাবলেন, ঠিক তাই। মুহূর্তে হতাশায় ডুবে গেলেন তিনি। তাঁর জীবনটাই মিথ্যা হয়ে গেছে। এতদিনের মাস্টারির টাকায় গাড়ি-বাড়ি,... সব করলেন। সব বৃথা হয়ে গেল। পরক্ষণে ভাবলেন, আর ভান করে থাকা নয়। এরপর ডাক্তারবাবুও ধরে ফেলবেন। তখন আর এক কেলেঙ্কারি হবে। আস্তে আস্তে নিজের চোখ দুটো খুলেই ফেললেন। তারপর ডাক্তারবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'আমার কী হয়েছে?'
রোগীর জ্ঞান ফিরে আসায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ডাক্তারবাবু। নিজের দুই ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে বললেন, 'কী আবার হবে, এত বলি তাও আমার কথা শোনেন না! ঠিক খালি পেটে ছিলেন অনেকক্ষণ।'
'তা একটু ছিলাম বৈকি।' হামিদ মাস্টার বললেন।
'আর যেন কখনও বেশিক্ষণ খালি পেটে থাকবেন না।' সতর্ক করে দিলেন ডাক্তারবাবু।
হামিদ মাস্টার বললেন, 'তাই হবে।'
ওদিকে আঁচলে মুখ ঢেকে প্রায় হেসেই ফেলেছিলেন আমিনা। শেষ মুহূর্তে কোনওরকমে হাসিটা চেপে ধরলেন।
হামিদ মাস্টার বুঝে ফেলে রেগে গেলেন স্ত্রীর ওপর। এত মানুষজন না থাকলে কড়া দু-চার কথা শুনিয়েই দিতেন তিনি। বড় ছেলে মনিরুল বাবাকে জিজ্ঞেস করল, 'বাইকে বসে বাড়ি যেতে পারবে?'
পাশ থেকে আমিনা বলে উঠলেন, 'হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব পারবে। আমি রবিউলের গাড়িতে যাচ্ছি। তুই ডাক্তারবাবুর টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে তোর আব্বাকে নিয়ে চলে আয়।'
স্ত্রীর দিকে আগুনে চোখে তাকালেন হামিদ মাস্টার। স্বর ফুটিয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।