বুনো লিলির গন্ধ

ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু বেশি বড় ফোটার দাপট নয়। পা অল্পস্বল্প কাদামাটিতে খেলছে কই মাছের মতো। রুগ্ন জুতোজোড়া পরার সময় পায়নি ননীবালা ঠাম্মা।

Remembering old puja days

রুবাইয়া জুঁই

ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু বেশি বড় ফোটার দাপট নয়। পা অল্পস্বল্প কাঁদামাটিতে খেলছে কই মাছের মতো। রুগ্ন জুতোজোড়া পরার সময় পায়নি ননীবালা ঠাম্মা। প্রাইমারি স্কুলের মাঠে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে তাঁর একমাত্র পিছুটান। আপ্রাণ দৌড়চ্ছে, ঝড় আসার মুহুর্তে ছোট্ট টুনটুনি পাখিটা বাতাসের তীব্র ঝাপটা উপেক্ষা করে কিভাবে ওড়ে? এতদিন ঠাম্মা ভাবত। আজ নিজেকে তাঁর ওই পাখিটাই মনে হচ্ছে। আরও দৌড়তে হবে তাঁকে নাহলে অনেককিছু হারিয়ে যাবে। শেষ এভাবে দৌড়ছে কিশোরীবেলায়। তখন গামারি গাছের ফুল কুড়োবার ধুম। সেসব শিশির স্মৃতি কতদিন মনে পড়ে না।পাড়ায় ননীবালা ঠাম্মার নাম কেউ জানেন না, ঠাম্মা নামেই পরিচিত। কারোর বাড়িতে শাক কুটে দিয়ে দশ টাকা পান তো আবার কারোর বাড়ির বাইরেটা ঝাড় দিয়ে। যেকোনো ছোট কাজ করাতে হলে ঠাম্মারই ডাক পড়ে। ভাঙাচোরা একটা টিনের চালার ঘরে নাতি গোপাল সহ থাকেন। স্বপ্ন ছিল নাতিটা পড়াশোনা করে চাকরি করবে। কিন্তু স্কুলের গন্ডি পেরিয়েই সে স্বপ্নে জল ঢেলেছে গোপাল। পাড়ার বিড়ির ঠেকে মদের ঠেকে তার দিনরাত্রি আড্ডা। ঘরে ফেরার নাম থাকে না।

সেই কোন ছোটবেলায়, এক যুগ আগে তখন ওর বয়স পাঁচ কি ছয় হবে। মা’টা চা বাগানে কাজ করতে করতে এক ভিনরাজ্যের শ্রমিকের সঙ্গে ভাবভালোবাসা করে পালিয়ে যায়। সেই থেকে গোপালের বাপটাও আর ঘরে ফেরেনি লজ্জায় ঘৃণায়। সেই যে নিরুদ্দেশ হয়েছিল লোকটা আর খোঁজ পায়নি কেউ। ননীবালা ঠাম্মা কত মানুষের কাছে যে ছেলের খোঁজ করেছে। কিন্তু ওই কোটরগত চোখ দুটো আজও আশা ছাড়েনি। মাঝেমধ্যে গোপাল রাগ করে বলত, ‘আর কতদিন খুঁজবে ছেলেরে বুড়ি’। ঠাম্মার সেই পরিচিত উত্তর, ‘যতদিন এই গাছে প্রাণ আছে রে ততদিন খুঁজব।’ ঝড়বাদলের দিনে এককোণ ঘেঁষে বসে থাকেন ননীবালা নাতিকে আড়াল করে। টিনের চালে ফুটো, টুপটাপ করে জল পড়ে সামান্য বৃষ্টিতেই। গোপাল বলেছে সিকিমে পাথর ভাঙার জন্য লোক যাচ্ছে। দিন তিনশো টাকা দেবে। সেও যাবে। পুজোর সময় ফিরে এলে নতুন টিন লাগাবে ঘরে। সে দেখেছে লোকের বাড়ি কাঁথা সেলাই করে বুড়ি এখনও। চোখের দৃষ্টি বড্ড ঝাপসা, সূঁচে সুতো ঢোকাতে পারে না তবুও এ বাড়ি সে বাড়ি কাঁথা সেলাই করে বেড়ায়। রোজগার হিসেবে কখনও একখানা পুরনো কাপড় কখনও ক'টা টাকা বা চাল। আর সেই পুরনো কাপড় পরেই বুড়ির দিন যায়। গোপাল ভেবেছে এবার পুজোয় তাকে একখানা শরতের কাশফুলের মতো ধবধবে শাড়ি কিনে এনে দেবে। খেঁকিয়ে উঠে ঠাম্মা বলে, ‘তোরে কোথাও যেতে হবেনি, নতুন টিন লাগবে না। এই ভাঙা ঘরেই থেকে নেব দুজনায়। কিন্তু তুই কোথাও যাস না গোপু। তোর বাপটাও আর ফিরল না। তোরে আমি কোথাও যেতে দিব না। আমি মরলে কে দেবে মুখে আগুন?’ বলতে বলতে বুড়ি কাঁদতে শুরু করে। গোপাল কথা বলে না সকালের ভাতটুকু পেয়াজ দিয়ে খেয়ে বাঁশের মাচায় শুয়ে পড়ে। ঘরে বিছানা বলতে বাঁশের মাচা একটা। সেখানে গোপাল শোয়। ননীবালা নীচে কাঁথা পেতে তার উপর শুয়ে, আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা এক করে। ঘর থেকে বেরিয়েই দরজার পাশে একটা ভাঙাচোরা মাটির উনুন। এখন উনুনের জন্য শক্ত মাটি আনতে পারেন না তিনি। গোপালও যেতে চায় না। গ্রামের একটা পুকুরের পাশেই কেবল পলিমাটি। ওই মাটিতে ভালো উনুন লেপা যায়। কিন্তু পুকুরের মালকিন সাকিনা বেওয়া খুব বকাঝকা করেন। তাই গোপাল ওমুখো হয় না।

***

ছেলেটা চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে। বিদ্যুতের আলোয় চকচক করছে গোপালের মুখ। মাথা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে বৃষ্টির জলে মিশে যাচ্ছে। নাতির এই অবস্থা দেখে আকুলিবিকুলি চিৎকার করছেন ননীবালা ঠাম্মা। কাকে ডাকবেন কোন আদালতে যাবেন বিচার চাইতে? সব তো অন্ধকারে শেওড়া গাছের মতো ঘুটঘুটে হয়ে আছে। তার মধ্যেই এমন ঝমঝমিয়ে আকাশ ভাঙছে। দুহাতে তার গোপালকে প্রাণপণে ওঠানোর চেষ্টা করছে অশীতিপর বৃদ্ধা। পেরে উঠছে না। একটা টর্চ লাইট এদিকে এগিয়ে আসছে দেখে বুড়ির প্রাণ ফিরে এল যেন।

‘কে কে...?’

‘আমি সত্যেন।’

সত্যেন গোপালেরই বয়সী, অনাথ। দুজনে গোপালকে তুলে গ্রামের হাসপাতালের দিকে ছোটে। হাসপাতালের গেট তো বন্ধ, বড় একটা তালা ঝুলছে। ‘গোপাল কথা বল ওরে গোপাল’ নাতিকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে ননীবালা... সত্যেন নাড়ি টিপে দেখে শ্বাস চলছে ধুকপুক করে।

সত্যেন লোকের গাড়ি ধোয়ার কাজ করে। কাল সকাল সকাল অনেক কাজ নিয়েছে তাই বুড়িকে বলে সে বাড়ির পথে রওনা দেয়। এই বৃষ্টিবাদলের রাতে দুটো প্রাণী ছাড়া এখানে কেউ নেই। একজনের প্রাণবায়ু ধুকপুক চলছে কি চলছে না বোঝা যায় না। আর একজন পৃথিবীর সমস্ত ঈশ্বরকে কাতরভাবে ডাকছেন তার নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও নাতিটাকে যেন সুস্থ করে দেন।

ভোরের আলো ফুটেছে। বুনো লিলির গন্ধে হাসপাতাল চত্ত্বর ভরে গেছে। কালো মেঘ সরে গিয়ে সাদা মেঘের খেলা শুরু হয়েছে। নাতিকে কোলে নিয়ে গেটের গায়ে হেলান দিয়ে বসে ননীবালা।

বেলা দশটার খানিক পর একজন চিকিৎসক আর দুজন নার্স গোপালকে পরীক্ষা করে জানান এক্ষুনি বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অবস্থা সংকটজনক। ততক্ষণে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে সেখানে তারাই ব্যবস্থা করে দেন অ্যাম্বুলেন্সের। গোপাল চোখ খোলার চেষ্টা করেও পারছে না। একফোঁটা জল তার মুখে ঢেলে দেয় ঠাম্মা।

একটা পুলিশের গাড়ি আর কয়েকজন পুলিশ আসেন বড় হাসপাতালে। ঘটনার জানাজানি হয়েছে ইতিমধ্যেই। ঠাম্মার পাড়ারই গুড্ডু রায়ের মোবাইল চুরি হয় বাড়ি থেকে। পরে যদিও সেই মোবাইল পাওয়া যায় গুড্ডুর প্রেমিকা লিপির কাছে। কিন্তু মোবাইল চুরির সন্দেহ গিয়ে পড়ে গোপালের দিকে। কারণ ও-ই বাড়িতেই ননীবালা কাঁথা সেলাই করছিলেন তিনদিন ধরে। গোপাল ভর দুপুরে বাড়ি ফিরে বুড়িকে দেখতে না পেয়ে গুড্ডুদের বাড়ি যায় ডাকতে। সেখানেই খানিকক্ষণ পাখার হাওয়ায় বসে জিরোয় সে। রাগের মাথায় গুড্ডুর বাবা ও দাদা গিয়ে চড়াও হয় গোপালের উপর। গোপালের কোনো কথাই তারা শুনতে চায় না। আচমকাই দুজনে মারতে শুরু করে। ভয়ে গোপাল গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের দিকে ছোটে। সেখানে গিয়েও পার পায় না। না খেতে পাওয়া দুর্বল শরীর ও-ই দুজনের লাঠির মার সহ্য করতে পারেনি। লুটিয়ে পড়ে ঘাসের উপর....। অবস্থা বেগতিক দেখে কেটে পড়ে তারা। পরে বিষয়টি জানাজানি হতেই পুলিশ ঘটনার তদন্তে নামে এবং মোবাইল পাওয়া যায় লিপির কাছে। কিন্তু গুড্ডুর বাবা শিবেন ও দাদা রমেন ততক্ষণে গ্রাম ছেড়ে পালায়।ভেঁজা শাড়িখানা গায়েই শুকিয়েছে ননীবালার। খালি পায়ে হাসপাতালের বারান্দায় জড়োসড়ো হয়ে বসে। পাশ দিয়ে অনেক জুতোর কটমট শব্দ। নীচে একটা মানুষ যে বসে রয়েছে সে খেয়াল কারোরই নেই। পুলিশ এসে ননীবালা ঠাম্মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ওইদিকে মন নেই তার, কোনো কথাই কানে ঢুকছে না।এমারজেন্সি ওয়ার্ডের ভেতর থেকে নার্স এসে পুলিশকে জানায় তিনঘণ্টা পর ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়া শুরু করতে। ননীবালা কি বুঝতে পেরেছে সে কথা! আচমকা 'ঠাম্মা.. ঠাম্মা'.. বলে কেউ ডাকছে। পেছন ফেরে ননীবালা। একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা ছেলে তার ঠাম্মার আঁচল ধরে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাড়ির পথে। ফুরফুরে রোদ উঠেছে। হাসপাতালের কৃষ্ণচূড়া গাছটাতে কয়েকটা কাক এদিক ওদিক করছে। গত রাতের সেই বুনো লিলির গন্ধটা আবারও জোরালো হচ্ছে...