পাগল নাকি! পুজোয় পাঠকদের আমি কী বার্তা দেব, ওরাই আমাকে বার্তা দেয়: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

Shirshendu Mukhopadhyay:

Eminent Bengali writer Shirshendu Mukhopadhyay talks about Durga Puja 2024 and his childhood memories ENT
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।

শহরের বাতাসে এখন নাক টানলেই পুজোর গন্ধ। সকালবেলার রোদেও ছাপ লেগেছে পুজোর। মিঠে, নরম। তবে এক জায়গায় গত প্রায় পঞ্চাশ বছরে বাঙালির পুজোর অভ্যেস এবার একটু থমকে দাঁড়িয়েছে। এবারের পুজোয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস বিহীন। শারীরিক সমস্যার কারণেই এই সামান্য বিরতি। তবে পুজোয় উপন্যাস না থাকলেও তাঁর মুখে পুজোর গল্প তো শোনা যেতেই পারে। সেই ফিকিরেই এই প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিকের কাছে হাজির হয়ে গিয়েছিল আজকাল ডট ইন। ছোটবেলার পুজোর স্মৃতির টুকরো টাকরা রোদ, মেঘ তুলে আনার পাশাপাশি এখনকার পুজোর জৌলুসের কথাও উঠে এল তাঁর মুখে। শুনলেন, রাহুল মজুমদার।

"আমার জন্মস্থান ময়মনসিংহ। অসম্ভব সুন্দর জায়গা ছিল। সেই সময়ের শহরগুলোয় গ্রাম গ্রাম ভাব ছিল। নদী মাঠ-ঘাট ঘেরা শহর। আমার বাবা রেলে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে দেশভাগের দুই-তিন বছর পূর্বেই বাবা দোমহনি থেকে ময়মনসিংহে বদলি হয়েছিলেন। আমি খুব আনন্দিত ছিলাম, ময়মনসিংহে আমরা এসেছি। বিক্রমপুরে আমার দেশ। ঢাকার বিক্রমপুর। ছোটবেলায় সেখানে দেখা পুজোর স্মৃতির উপর এখনও সেভাবে কুয়াশা জাঁকিয়ে পড়েনি। যাই হোক, তখনকার পুজো এখনকার পুজোর জৌলুসের তুলনায় কিছুই ছিল না। অনেক জায়গা তো তখন বিদ্যুৎহীন ছিল। প্যান্ডেলের সাইজও যে বিরাট হত, এমনটা নয়। অনেক দুর্গাপুজো তো হ্যাজাকের আলোয় হত। গ্রাম, মফসসলের বেশিরভাগ মণ্ডপের সাজসজ্জা রাংতা, কাগজের চিকলি দিয়েই হত। সঙ্গে অবশ্যই থাকত টাটকা ফুল। এবং প্রতিদিন পাল্টে যেত সেই ফুল। " 

"সেটা চারের দশক। তখন খুব বেশি পুজো হতও না আশেপাশে। খুব সাধ থাকলেও তা সাধ্যে পরিণত করার সামর্থ্য ছিল না মানুষের। বেশিরভাগ পুজোয় আনা হত একচালার দুর্গা প্রতিমা। গায়ে গায়েও এত মণ্ডপ থাকার কোনও প্রশ্নই ছিল না। একটা মণ্ডপ দেখার জন্য অনেকটা হাঁটতে হত। তখনকার সময়ে একটা মফসসলে মোট পাঁচ থেকে ছ'টা পুজো হত বড়জোর। আর তখন কিন্তু সর্বজনীন পুজোর চল ছিল না বললেই চলে। সেসব শুরু হয় আরও অনেক পরে। আমাদের ছোটবেলায় গ্রামের জমিদার বাড়ি অথবা হাতে গোনা খুব বড়লোক কয়েকজনের বাড়িতে হয়তো দুর্গা পুজো হত...বেশিরভাগ তাই-ই হত। তবে রাস্তায় কিন্তু লোক হত। ড্যাং ড্যাং করে লোকজন বেরিয়ে পড়তেন ওই ছোট্ট-ছোট্ট মণ্ডপ, প্রতিমা দেখতেই।"

"আর...আর মহিলারা সেই সময় খুব ঘুরে ঘুরে পুজো দেখতে বেরোতেন না। হয়তো বাড়ির সামনে পাড়ায় পুজো হচ্ছে, সেখানে গেলেন। একটু বসলেন, গল্পগাছা করলেন ব্যস! পুজোর গল্প করতে করতে একটা কথা মনে পড়ল সেটা এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি। আমাদের বাড়িতেও কিন্ত কয়েকবার দুর্গা পুজো হয়েছে। এই ছোট্ট প্রতিমা আনা হত, সামান্য আয়োজন...এই আর কি...তাতেই কী আনন্দটাই যে হত তা বলে বোঝাতে পারব না।" বলতে বলতে খানিক আনমনা হয়ে গেলেন বর্ষীয়ান সাহিত্যিক।

"...যখন বড় হলাম, কলকাতায় থাকা শুরু করলাম, সেই সময় এখানকার পুজো দেখেছি। মনে পড়ে, ফায়ার ব্রিগেডের পুজোর কথা। খুব বড়, খুব বড়! ফায়ার ব্রিগেডের সংস্থার পুজো মানেই বিশাল উচ্চতার প্রতিমা। আর আয়োজনেও থাকত তেমন জাঁকজমক। তারপর লেখালেখি শুরু হল। ওটাই তো আমার আসল পুজো..." বলতে বলতে তৃপ্তির হাসি খেলে গেল 'গোঁসাইবাগানের ভূত' উপন্যাস স্রষ্টার। সামান্য থেমে ফের বলা শুরু করলেন 'দূরবীন'-এর লেখক, " আমার ছেলে-মেয়ে যখন ছোট, সেটা সাতের দশক হবে, তখন পরপর কয়েক বছর বেরিয়েছি ওদের নিয়ে ঠাকুর দেখতে। মেয়েকে কোলে নিয়ে, ছেলেকে কাঁধে চাপিয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরতাম। তবে বেশি ঘুরতাম না। কারণ আমার খুব ভয় ছিল যে ছেলে-মেয়ে যদি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায় বা কিছু হয়ে যায়...সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়েরা যেমন অতিরিক্ত সাবধানী হয় আর কি। তাই অল্প কয়েকটা মণ্ডপ ঘুরেই তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পিঠটান দিতাম।"

প্রশ্ন ছিল এখন পুজোতে রাস্তায় এত মানুষের ভিড়, এত গাড়ির ধাক্কাধাক্কি, আওয়াজের‌ জগঝম্প চলে তাতে কি বিরক্ত হন? মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জবাব, "না, না, এক ফোঁটাও না। মানুষ আনন্দ করছে তাতে কেন বিরক্ত হব? মানুষ আনন্দ করছে, করতে পারছে এটাও একটা ভাল ব্যাপার। কারণ মানুষ তো খুব একটা আনন্দময় জীবন কাটাতে পারে না, তাই যদি কিছু আনন্দময় মুহূর্ত কাটানোর সুযোগ তার কাছে আসে এবং তা সে উপভোগ করে, খারাপ কি? তবে আমি নিজে পুজোয় ভিড়ের মধ্যে ঘুরতে ভালবাসি না, এটুকুই। বেশ কয়েকবার দুর্গা পুজোর বিচারক হওয়ার সুবাদে ঘুরফিরে নানা কিসিমের মণ্ডপ দেখেছিলাম। ওটুকুই।"

পুজোর লেখা নিয়ে প্রসঙ্গ উঠতেই শীর্ষেন্দবাবু বললেন, "লেখক হওয়ার পর অবশ্য পুজোবার্ষিকীতে লেখা বেরনো নিয়ে বেশ উত্তেজিত থাকতাম। আজও থাকি। লেখালেখির এত বছরে এই প্রথম এবারের পুজোতে আমার কোনও লেখা বেরলো না। শরীরটা খারাপ ছিল, তাই লিখিনি। এটা কিন্তু আলসেমো নয়, শরীরটা একটু বেগড়বাই করছিল। একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তাই, কিন্তু কি আর করা যাবে! তবে ইচ্ছে আছে, সামনের বছর পুজোতে দুটো উপন্যাস লিখব। ভীষণ ইচ্ছে আছে। দেখা যাক্..."

আড্ডার একেবারে শেষে খানিক আগ্রহ নিয়েই শীর্ষেন্দুবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, পুজোয় পাঠকদের কী বার্তা দেবেন? শোনামাত্রই হাসতে হাসতে হাত নাড়িয়ে 'পাতালঘর'-এর লেখক এক মুখ হাসি ছড়িয়ে বলে উঠলেন, "পাগল নাকি! পুজোয় পাঠকদের আমি কী বার্তা দেব, ওরাই আমাকে বার্তা দেয়!"