কলকাতার কার্নিভ্যাল নয়, ঢাক-নারকোল আর ‘গরু খোঁজা’য় গ্রামের পুজোই খরাজ মুখোপাধ্যায়ের হৃদয়ের ‘শারদ গৌরব’

Kharaj Mukherjee: খরাজ মুখোপাধ্যায়ের শৈশব কেটেছে বীরভূমের এক গ্রামে, নাম পাথাই। অভিনেতার কথায়, “ব্যাকরণ মেনে যাকে বলে পুরোপুরি গ্রাম।” আড়ম্বর নয়, সেখানকার উৎসবে তিনি মিশে থাকতে দেখেছেন প্রবল আন্তরিকতা। উৎসবের কথা বলতে গিয়ে অতীত ফিরে দেখেন অভিনেতা।

Kharaj Mukherjee recalls childhood Durga Puja: Coconut games and cow hunts


বাংলা ছবিতে তিনি চর্চিত অভিনেতা। রবি কিনাগী, সুজিত মণ্ডল, রাজা চন্দ থেকে শুরু করে বলিউডে একের পর এক বড় বড় তারকাসর্বস্ব ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। বলা ভাল, করে চলেছেন। তিনি, খরাজ মুখোপাধ্যায়। হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেছেন তিনি। খরাজের শৈশব কেটেছে বীরভূমের এক গ্রামে, নাম পাথাই। অভিনেতার কথায়, “ব্যাকরণ মেনে যাকে বলে পুরোপুরি গ্রাম।” আড়ম্বর নয়, সেখানকার উৎসবে তিনি মিশে থাকতে দেখেছেন প্রবল আন্তরিকতা। উৎসবের কথা বলতে গিয়ে অতীত ফিরে দেখেন অভিনেতা।

“আমাদের গ্রাম তারাপীঠের কাছাকাছি। সাঁইথিয়ার পরের স্টেশন গদাধরপুর। তার কাছেই আমার গ্রাম, পাথাই। কলেজ পাশ করার আগে পর্যন্ত কলকাতার পুজো কখনও দেখতে পাইনি। পুজোর আগে শুধু দেখতাম মণ্ডপ বাঁধা হচ্ছে আর পুজোর পরে খোলা হচ্ছে। কারণ নিয়ম করে পুজোর সময় গ্রামের বাড়িতে আমরা মহালয়ার পরপরই সপরিবারে চলে আসতাম। শুধু মনে আছে, নর্দান পার্কে বিশাল এক দূর্গা প্রতিমা তৈরি হত, মণ্ডপের মধ্যেই। ওই দেখেই হাঁ হয়ে যেতাম। মনে হত, ব্যাপারে কলকাতায় দেবীর এত বড় প্রতিমা তৈরি হয়!”  

“পুজোয় আমরা কোনওদিনই বেশি সাজগোজ করতে পারতাম না। কারণ যে গ্রামে আমাদের বাড়ি ছিল, সে গ্রামের প্রায় অধিকাংশ বাসিন্দার আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভাল ছিল না। তাই বাবার নির্দেশ ছিল আমাদের, ‘যেদিন ওদের গায়ে পোশাক তুলে দিতে পারবে, সেদিন পুজোয় সাজগোজ করবে। নইলে করবে না। একটা ধুতি, একটি গেঞ্জি, কাঁধে গামছা ব্যাস! মিলেমিশে থাকবে ওঁদের সঙ্গে। মনে রাখবে উৎসবটা সবার, একার নয়। বাবার সেই উপদেশ আজও ভুলিনি। আজও দেশের বাড়িতে পুজোর সময় যদি যায়, ওই পোশাকই থাকে আমার পরনে। আমি পুজো প্যান্ডেলও কখনও  উদ্বোধন করি না। কারণ সেই যে বাবার নির্দেশ -যেটা তোমার বিষয় নয়, সেখানে মাথা গলাবে না। সাংস্কৃতিক বিষয় হলে আলাদা, ধর্মীয় ব্যাপারটা তোমার নয়, তাই সেখানে যাবে না। পরবর্তী সময়ে বহু প্রস্তাব পেয়েছি মণ্ডপ উদযাপনের, পারিশ্রমিক হিসেবে ছিল মোটা অঙ্কের টাকা তবু আমি কিন্তু করিনি। যাই হোক...”

“এরপর অভিনয়, গানের অনুষ্ঠান শুরু করার পর কখনও অর্ধেক পুজো এখানে কাটিয়ে বাকিটা গ্রামের বাড়িতে কাটিয়েছি। কখনও বা কাজের চাপে যেতেই পারিনি গ্রামে। তখন কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে গ্রামের বাড়ির পুজো খুব মিস করেছি। তবে তখন কিন্তু কলকাতার পুজো দেখে বুঝেছি, আন্তর্জাতিক স্তরের কার্নিভ্যাল কাকে বলে! পুরো যেন ভোজবাজি। এক লহমায় ক’দিনের জন্য বদলে যায় গোটা কলকাতা।”  


“ফিরি আমাদের গ্রামের পুজোর কথায়। আমাদের গ্রামে কিন্তু অদ্ভুত সব মজার ঘটনা হয় পুজোর সময়। অদ্ভুত সব রীতি, অদ্ভুত সব খেলা হয়। দু'টো খেলার কথা বলি। নবমীর দিনে যে খেলাটা হয় তার নাম, ‘নারকোল কাড়াকাড়ি’! অনেকটা রাগবি খেলার গ্রাম্য সংস্করণ। ব্যাপারটা হল,একটা না-ছাড়ানো শুকনো নারকোল নেওয়া হয়, তারপর সেটাকে তেলে চুবানো হয়।  দু'জন ষণ্ডা প্রতিযোগী থাকে। তাঁদেরকেও গুছিয়ে সর্ষের তেল মাখানো হয়। এবার শুরু হয় মৃদু তালে ঢাক বাজানো। ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। যেই মুহূর্তে তীব্র হয়ে ওঠে ঢাকের আওয়াজ, ছুঁড়ে দেওয়া হয় ওই নারকোল। এবার ওই নারকোলটিকে ধরে প্রতিপক্ষকে টপকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যে পৌঁছতে পারবে, সেই হবে জয়ী। এর উপর আবার প্রতিযোগীদের মাথায়, শরীর লক্ষ্য করে জনতা বালতি বালতি জল ঢালে দর্শক! সঙ্গে চলে হল্লা। ফলে বুঝতেই পারছেন, আছাড় খেয়ে, পিছলে পড়ে সেই খেলা হয়ে ওঠে আরও শতগুণে কঠিন।” 

“দশমীর দিন আমাদের গ্রামে প্রতিমা নিরঞ্জন হয় না। নবপত্রিকা বিসর্জনের পর মিষ্টিমুখ হয়। সেদিনই হয় এই খেলা। নাম, ‘গরু খোঁজা’। সেদিন সকাল থেকে আশেপাশের গ্রামের সমস্ত বাড়ির গরুদের স্নান করিয়ে পরিষ্কার করা হয়, শিং, খুরে তেল মাখানো হয়। এরপর আমাদের গ্রামের সবথেকে বড় ময়দানে সেইসব গরুদের নিয়ে হাজির হয় তাদের মালিকেরা। প্রায় ২৫০-৩০০ গরু থাকে। তাদের সঙ্গে হাজির হয় আশেপাশে সব গ্রামের মণ্ডপের ঢাকিরা, সেও ধরুন... কমপক্ষে ২০জন। গরুদের ময়দানের মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে  অনেকটা জায়গা জুড়ে ঘিরে থাকে দর্শক ও ঢাকিরা। আচমকা চারপাশ শান্ত করা হয়। গরুগুলো খানিক ধাতস্থ হয়ে যখন ঘাস খাওয়া, জাবর কাটা শুরু করে, তখনই আচমকা একসঙ্গে সবকটা ঢাক বাজানো শুরু হয়! চমকে গিয়ে, পরিত্রাহি রব তুলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করে গরুগুলো। কেউ তাদের আটকায় না। এর বেশ খানিকক্ষণ পর থেকে তাদের খুঁজতে শুরু করে তাদের মালিকেরা। ততক্ষণে তো সব গরু ভোঁ-ভা!  এমনও হয়েছে  রাট ১২টার সময় অনেকে তাঁদের গরু খুঁজে নিয়ে গোয়ালে ফিরেছেন। গোটা গ্রাম কিন্তু জেগে বসে থাকে। আসলে, এই খেলা মানুষ ও পোষ্যের মধ্যে বন্ধন মজবুত করার লক্ষ্যেই খেলা হয়। অর্থাৎ, যে প্রাণীটি তোমার এত কাজে লাগছে, তাঁকে তুমি কত ভালবাসো এই খুঁজে নিয়ে আসা থেকেই তোমাকে প্রমাণ করতে হবে। একইসঙ্গে মজার এবং শিক্ষণীয় এই 'গরু খোঁজা' খেলা।” 

“কলকাতার পুজোয় বৈভবের হয়ত ছিটেফোঁটাও আমাদের গ্রামে নেই। কিন্তু আড়ম্বড় না থাকলেও মজা, আন্তরিকতায় কমতি নেই। তাই আমাদের গ্রামের পুজোর বাস আমার হৃদয়ে, আমার স্মৃতিতে।”